টবে বা পলিব্যাগে খুব সহজেই লঙ্কা ফলানো যায়। খুব একটা পরিচর্যারও প্রয়োজন নেই। সাধের ছাদ ও ব্যালকনি বাগানে আপনি যদি গোটা চারেক টবে লঙ্কার চারা বসান, তাহলে আপনাকে বাজার থেকে কাঁচা লঙ্কা কিনতে হবে না।
আমরা নিত্যদিনের রান্নায় ব্যবহার করি মূলত দু'ধরণের লঙ্কা। একটা পুরো সবুজ, অন্যটা কালচে রঙের। এবার এগুলোর আকার অনেক রকমের হয়, ঝালের মাত্রাও বিভিন্ন হয়; সেই অনুযায়ী এদের নামও আলাদা আলাদা হয়। কিছু লঙ্কা ওপরের দিকে লেজ উঁচিয়ে থোকায় থোকায় ফলে; আবার কিছু কিছু জাতের লঙ্কা পাতার কোলে কোলে একটি করে ফলে--এরা আবার মাটির দিকে লেজ নামিয়ে থাকে। তবে যেমনই লঙ্কা হোক, তার জাত যাই হোক-না কেন, তাদের পরিচর্যা কিন্তু একই।
বাজারের গাছ বিক্রেতার কাছ থেকে লঙ্কার চারা এনে (যেহেতু এই চারাগুলো অধিকাংশক্ষেত্রেই উপড়ে আনা হয়ে থাকে, তাই), আধ কাপ পরিষ্কার জলে এক চিমটি হলুদ গুঁড়ো গুলে তাতে শেকড়শুদ্ধ গোড়াটা ডুবিয়ে কয়েকঘন্টা রেখে দিতে হবে ছায়ায়। বাড়িতে যদি রুট হরমোন, ফাঙ্গিসাইড ও এপসম সল্ট থাকে, তাহলে প্রত্যেকটি এক চিমটে পরিমাণে জলে গুলে তাতে শেকড় ও কাণ্ড ডুবিয়ে রাখলে চারাগুলো এক্কেবারে সতেজ হয়ে ওঠে এবং মরে যাওয়ার একেবারেই চান্স থাকে না। এমনিতেও লঙ্কার চারার জীবনীশক্তি খুব ভালো, চট করে মরে যায় না। তবুও এভাবে পরিচর্যা করে দশটা কমবেশি সতেজ চারা বসালে দশটাই বেঁচে যায়।
লঙ্কা যেকোন মাটিতেই ভালোভাবে বেড়ে ওঠে, ফল দেয়। বেলে-কাঁকুরে সব মাটিতেই। তবে আমরা যেহেতু টবে যত্ন করে চাষ করছি, তাই মাটির ব্যাপারেও হেলাফেলা একদম করবো না। দোআঁশ মাটি সব গাছই বেশি বেশি ভালোবাসে। আর গোড়ায় জল জমা কোন গাছই পছন্দ করে না। তাই দেড় ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে, দেড় ভাগ মোটাদানা বালি ও এক ভাগ পুরনো গোবর বা ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে প্রথমে। তারপর সেই মাটি দিয়ে জলনিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত আট ইঞ্চি টবের আশিভাগ ভর্তি করে নিতে হবে। এবার টবের মধ্যিখানে গর্ত করে বসিয়ে দিতে হবে এক-একটি চারা। টবে জল দিয়ে গাছশুদ্ধ টবটি ছায়ায় রেখে দিতে হবে সাতদিন। এই সাতদিন টবের মাটি ভেজা থাকবে, তাই আর জল দিতে হবে না।
সাতদিনের মধ্যেই লঙ্কার চারা মাটি ধরে নেবে। এই সময় ডগায় চিকন চিকন পাতার সম্ভাবনা দেখা দেয়। গাছ একেবারে সতেজ চনমনে হয়ে থাকে। গাছ যেহেতু পুরো ছায়ায় ছিল সাতদিন; তাই আট দিনের দিন অল্পসময় রোদে রাখতে হবে, তারপর তুলে নিতে হবে টব। দিন চারেক ধরে এভাবে ক্রমে ক্রমে রোদ সইয়ে ফুল সানলাইটে রাখতে হবে। এই খাটনিটুকু করলে গাছের ধকল কম হবে। নইলে হঠাৎ চড়া রোদের ধাক্কা সামলাতে না-পেরে অনেক সময় গাছ ঝিমিয়ে পড়ে।
লঙ্কা এমন একটি গাছ, যে, চড়া রোদে অর্থাৎ যেখানে আট ঘণ্টা রোদ আসে সেখানেও খুব ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। আবার যেখানে দিনে মাত্র আধ ঘন্টা রোদ আসে, সেখানেও সে বেশ চনমনে থাকে। তবে কম রোদে বৃদ্ধি কম হয় ও ফল কম দেয়। তাছাড়া গাছের সতেজতার কিন্তু কোন হেরফের হয় না।
লঙ্কা গাছের কোন কাটিং করার প্রয়োজন পড়ে না। সে আপনা আপনিই ডাল বাড়ায়, ঝোপালো হয়। দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে ফুল আসে, ফল ধরে।
এবার বলি পরিচর্যার কথা। মাটির রস কম মনে হলে, তখনই জল দেবেন। আগাছা হতে দেবেন না টবে, সবসময় পরিষ্কার রাখবেন। টবের মাটি সপ্তাহে একবার খুঁড়ে আলগা আলগা রাখবেন। মাসে একবার ভার্মি কম্পোস্ট বা পুরনো গোবর সার দেবেন প্রতি টবে চার মুঠো করে। খোলপচা জল ও সবজি খোসা পচানো জল এ-সপ্তাহে ও-সপ্তাহে অদল-বদল করে দিতে হবে। সাতদিন পর পর। আমি এভাবেই টবে লঙ্কা চাষ করি। আপনার যদি এই জৈব পদ্ধতির খাবার (খোল পচা ও সবজিখোসা পচা জল) তৈরি ঝামেলার বলে মনে হয়; তাহলে আপনি রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে খুব অল্প পরিমাণে রাসায়নিক সার দিতে হয়। তার জন্য 15:15:15 কিনে আনবেন। এটা NPK সার অর্থাৎ নাইট্রোজেন, পটাশ ও ফসফেটের একটা আনুপাতিক মিশ্রণ। এটা শুধু লঙ্কা নয়, যেকোন সবজি গাছেই দেওয়া যায়। লঙ্কার জন্য প্রতি পনের থেকে সতের দিন অন্তর এক চা-চামচ করে প্রতিটি টবে গাছের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে গোল করে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই হবে, আর কিচ্ছু করতে হবে না।
লঙ্কা গাছের একটা সমস্যা খুব হয়। সমস্যাটা মূলত নতুন গাছ প্রথম ফল দেবার আগেই দেখা যায়। সমস্যার শুরুতেই গাছে সরু এবং অত্যন্ত ছোট ছোট পাতাওয়ালা ডগা দেখা যায়। সেগুলো দেখবেন, একটু হলুদ-সবুজ রঙের। আর ল্যাং-প্যাং করে বাড়ে। এই অবস্থায় ফুল আসবে, কিন্তু ফল হবে না। এরকম দেখলে একেবারেই দেরি করবেন না। এই রোগ সরানোর কোন নির্বিষ টোটকা নেই। তাই ফালতু সময় নষ্ট না-করে ইমিডিয়েট 'ইমিডাক্লোরোপিড' গ্রূপের কীটনাশক কিনে এনে স্প্রে করে দেবেন। প্রথবার স্প্রে করার সাতদিন পরেও যদি দেখেন সুস্থ পাতা বেরোচ্ছে না, তখন আর একবার স্প্রে করে দেবেন। তাহলেই দেখবেন আপনার গাছ ক্রমে সুস্থ ও ফলবতী হয়ে উঠছে।
লঙ্কা গাছ এভাবে পরিচর্যা করে রাখতে পারলে এক-একটি গাছ তিন থেকে চার বছর ভালো ফল দেয়। যখন ফল দেয়, অনেকদিন, প্রায় মাস ছয়েক টানা ফল দেয়। এবং প্রচুর ফল দেয়। তবে একবার ফল দেওয়ার পর গাছ একমাস থেকে দু'মাস বিশ্রাম নেয়। তারপর আবার ফল দেওয়া শুরু করে। তার এই বিশ্রামকে ফল দেওয়া শেষ ভেবে গাছ নষ্ট করবেন না। আর যত্নেরও ত্রুটি করবেন না। দেখবেন, বাজার থেকে আর কাঁচালঙ্কা কিনতে হবে না।....