‘আজ তারায় তারায় দীপ্তশিখায় অগ্নি জ্বলে নিদ্রাবিহীন গগনতলে’ – রবীন্দ্রনাথের এই গান আমাদের বহুবার শোনা কিন্তু এই ‘নিদ্রাবিহীন গগনতলে’র খবর আমরা কতটা রাখি? কতবার দেখি তার সুবিস্তীর্ণ আঁচলে থাকা আশ্চর্য সব গ্রহতারকাকে?
প্রাচীন কাল থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তের আগ্রহী মানুষজন কিন্তু আকাশের অনন্ত রহস্য ভেদ করতে উৎসুক হয়েছে। চোখের আলোয় দেখতে চেয়েছে অচেনাকে, অজানাকে। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহষ্পতি বা জুপিটারের চারটি চাঁদ আবিষ্কার করেছিলেন। আকাশে চোখ পেতে দেখা পেয়েছিলেন শনি বা স্যাটার্নের চারপাশে থাকা ডিম্বাকৃতির বলয়েরও। এই ঘটনার তেরো বছর পর ১৬ জুলাই ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে জুপিটার আর স্যাটার্ন খুব কাছে এসেছিল – ঠিক এবারের মতো। গ্যালিলিও তখন জীবিত থাকলেও গ্রহদের অবস্থানগত কারণে পৃথিবী থেকে তাদের দেখা সম্ভব হয়নি।
প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই দুই গ্রহকে ধীরতম গতির দুই গ্রহ বলে অভিহিত করে ছিলেন। বৃহস্পতি বা জুপিটার সূর্য প্রদক্ষিণে সময় নেয় ১২ বছরের মতো আর শনি বা স্যাটার্ন নেয় সাড়ে ঊণত্রিশ বছর। মনে রাখতে হবে, আমাদের পৃথিবীর লাগে ৩৬৫ দিনের কিছু বেশি। এই ধীরগতির জন্যই ওদের মিলন সহজে হয় না। মোটামুটি ভাবে প্রতি কুড়ি বছর পরপর জুপিটার আর স্যাটার্ন আসে কাছাকাছি। ২০০০ সালেও ওরা কাছে এসেছিল। কিন্তু এবছরের কাছে আসাটা খুবই ব্যতিক্রমী। আটশো বছর আগে, গ্যালিলিওর সময়কালেরও আগে বৃহস্পতি আর শনি – আমাদের সৌরমন্ডলের দূরতম দুই গ্রহ মহাকাশে ঠিক এবারের মতো একই সরলরেখায় এসেছিল। অর্থাৎ তখন এদের অবস্থান পৃথিবী থেকে দেখলে যেমন দেখাত এবারও তেমনই দেখাচ্ছে। ২০০০ সালের কাছে আসার সঙ্গে এর অবস্থানগত পার্থক্য আছে।
২০২০-র ২১ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের পরে আকাশের দক্ষিণ – পশ্চিম কোণে এই দুই গ্রহকে বেশ কাছাকাছি দেখা যাবে। দূরবীণ অথবা টেলিস্কোপ থাকলে তো কথাই নেই। দেখতে পারা যাবে খালি চোখেও। তবে খালি চোখে এদের দূর আকাশে উজ্জ্বলতম একটি বড় গ্রহ বলে মনে হতে পারে। টেলিস্কোপে দেখলে দুই গ্রহের মধ্যের ফাঁক দেখা যাবে। এদের ঔজ্জ্বল্য এদের চিনতে সাহায্য করবে। এরপরের কাছে আসার দিনটি হবে ২০৮০ সালের ১৫ মার্চ। খালি চোখে এক মনে হলেও আসলে ওদের মধ্যেকার দূরত্ব কিন্তু ৭৩৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। সাধারণত যখন জুপিটার আর স্যাটার্ন সরলরেখায় আসে তখন তারা এক ডিগ্রির পার্থক্য রাখে। অর্থাৎ তাদের মধ্যেকার দূরত্ব হয় চাঁদের আনুমানিক ব্যাসের দ্বিগুণ।
এই বিরল মহাজাগতিক দৃশ্য কিন্তু সারা পৃথিবী থেকে ভাল ভাবে দেখা যাবে না। বিষুবরেখার কাছাকাছি থাকা অঞ্চল থেকেই এদের ভালো দেখা যাবে। এ বছরের বৃহষ্পতি আর শনির কাছে আসাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে এই কারণে যে এই দিনটিতে উত্তর গোলার্ধে দিন হয় ক্ষুদ্রতম। তাই তাড়াতাড়ি সূর্যাস্ত হলে আকাশ দেখারও সুবিধা। অনেকের ভ্রান্ত ধারণা আছে যে এসব মহাজাগতিক ঘটনায় মানবদেহে নানান প্রভাব পড়ে। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাই নির্ভয়ে পরম আনন্দে সাক্ষী হতে পারেন এক বিরল দৃশ্যের।
কীভাবে দেখবেন ওদের? দূরপ্রান্তের দুই গ্রহকে? শহরসীমার বাইরে অথবা উঁচু ছাদ থেকে সূর্যাস্তের পর, সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা পর্যন্ত চোখ রাখুন দক্ষিণ – পশ্চিম আকাশে। প্রথমে দেখা দেবে ঝলমলে বৃহস্পতি - জুপিটার, আমাদের সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ। তারপর আসবে একটু কম উজ্জ্বল সুন্দরী স্যাটার্ন - শনি। বৃহষ্পতির বাম দিকে একটু ওপরে থাকবে সে। উজ্জ্বল দুই গ্রহ নক্ষত্রের মতো ঝিলমিল করবে না। থাকবে স্থির ঔজ্জ্বল্যে নিজের জায়গায়। এই কাছে আসার আশ্চর্য ঘটনা জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেপলারকে অন্য এক ভাবনার জগতে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল বাইবেল কথিত 'বেথলেহেমের তারা’ও কি আসলে এই 'গ্রেট কঞ্জাংশান' (great conjunction)-এরই ঘটনা? নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে ২০২০-র ভয়ঙ্কর বছর শেষে এই বিরল মিলন সেই 'বেথেলহেমের তারা'-র মতোই শান্তির প্রতীক হয়ে আসুক এই কামনা করাই যায়।।