আমাদের বাংলার 'গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন'

'ক্যানিয়ন' বললে প্রথমেই মনে পড়ে যায় ভূগোলের বইতে পড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভুক্ত 'অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের' কথা, নদীর স্রোতের শিল্পকর্মের নিদর্শন হল এই ক্যানিয়ন। তবে অনেকেই জানেন না হয়ত আমাদের বাংলাতেও রয়েছে ঠিক এমনই এক গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, তার নাম 'গনগনি'

পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা শহরে এর অবস্থান। আর এই ক্যানিয়নের স্রষ্টা হল 'শিলাবতী নদী' যার আদুরে নাম 'শিলাই'। বছরের অন্যান্য সময়ে নদীটি যথেষ্ট শান্ত, তবে বর্ষাকালে দেখা যায় এর ভয়ানক রূপ। বহুবছর আগে তৈরী এই গনগনি আজও তার দৃঢ় চেহারা নিয়ে স্বমহিমায় সমানভাবে বর্তমান।

গড়বেতা থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে হুমগড়ের দিকে, সেই পথে কিছুটা এগোলেই পাওয়া যাবে দেড় কিলোমিটারেরও বেশী জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই গনগনি। প্রকৃতির শৌর্য্য ও খামখেয়ালী স্বভাবের এক বিস্ময়কর নিদর্শন এটি। সকালের সূর্য যেন লাল রঙ ছড়িয়ে দেয় গেরুয়া পাথরের জমিতে। নীল আকাশের সাথে লাল-গেরুয়া ও সবুজ ঘাসের চাদর এক অপরূপ সৌন্দর্য্যময় দৃশ্যের সৃষ্টি করে যা হয়ত সেখানে গিয়ে উপলব্ধি না করলে বোঝা সম্ভব নয়। মনুষ্যকৃত স্থাপত্য-ভাস্কর্যের কাছে প্রকৃতির শিল্পের কোনো তুলনা সত্যিই হয় না।

'ল্যাটেরাইট শিলা'য় তৈরী এই ক্যানিয়ন। শিলাবতী নদীর ক্রমাগত ক্ষয়কার্যের ফলে তৈরী হয়েছে এটি। যে শিলাবতী এখন শীর্ণ তারই জলোচ্ছাসের আঘাতে ও ঝড়-জল-বাতাসের খেলায় আজ গনগনি এরকম চেহারা নিয়েছে। নিজের শাণিত কল্পনাশক্তির ব্যবহার যদি করা যায় তাহলে এই ভূমিরূপের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে কোথাও পিরামিড, দূর্গ, বাড়ি বা মন্দিরের থাম, আবার কোথাও বা পৌরাণিক দেবদেবী, ডায়নোসর এরকম নানাবিধ পাথরের অবয়ব। শিলাই নদীর এই অসামান্য ভাস্কর্য অবাক করার মতোই।

এই গনগনির সৌন্দর্য্য ও কারুকলা যেমন, ঠিক তেমনই রয়েছে পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত। পুরাণমতে মহাভারতে বর্ণিত আছে এই গনগনির কথা। পঞ্চপান্ডবরা অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন এই অঞ্চলেই কিছুদিন ছিলেন। এখানে পান্ডুপুত্র ভীম ও বকরাক্ষসের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যেখানে ভীম বকরাক্ষসকে হত্যা করেছিলেন। বলা হয় এই গিরিখাত তাদের ভয়ানক যুদ্ধের ফলেই সৃষ্ট।

আর ঐতিহাসিক বর্ণনা বলে 'চুয়াড়' বিদ্রোহের সময় এই বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অচল সিংহ তার দলবল নিয়ে আস্তানা তৈরী করেছিলেন গনগনির গভীর শালবনে। নানান কলাকৌশল শিখে নিজেদেরকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলেন তাঁরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ইংরেজরা কামান দেগে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল গোটা শালবনে। শেষে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়তে হয় তাঁদের আর সমাপ্তি ঘটে সেই যুদ্ধের। এই গনগনির মাঠেই অচল সিংহ ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়।

প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক-সব মিলিয়ে এই জায়গা হয়ে উঠেছে দর্শক-পর্যটকদের কাছে চিত্তাকর্ষক। আমেরিকা নাহয় নাই বা হল তারই এক ক্ষুদ্র রূপ যে আমাদের বাংলাতেও রয়েছে, সেই স্বাদ পাওয়াটাই বা কম কি!

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...