গৌরীপুর, উত্তর ২৪ পরগণার এক প্রাচীন জনপদ। সেখানে অধিষ্ঠান করেন দেবী কালী। মন্দিরের নাম গৌরীপুর কালী বাড়ি। কালী মন্দিরটি সুপ্রাচীন। দমদম বিমানবন্দর থেকে যশোর রোড ধরে মধ্যমগ্রাম, বারাসাত যাওয়ার সময় রাস্তার উপরেই চোখে পড়ে এই মন্দির। এক রত্ন মন্দির। বাদামি রঙের মন্দির। রাস্তায় যাতায়াতের পথে অনেকেই দেবী কালিকাকে প্রণাম করেন। আবার গাড়ি থামিয়ে অনেকেই মন্দিরে এসে পুজো দিয়ে যান। বিরাটির এই গৌরীপুর কালী মন্দিরে ফি দিন পুজো দিতে ভক্ত সমাগম। মায়ের পুজো না করে, ওই চত্বরে কোনও নতুন গাড়ি রাস্তায় চলতে শুরু করে না। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চলন্ত বাস থেকে কন্ডাক্টরেরা পয়সা ছুঁড়ে দেন। বিশ্বাস থাকে, দেবী রাস্তায় যাবতীয় বিপদ, দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করবেন।
এই অঞ্চল অর্থাৎ বিরাটি ছিল সাবর্ণদের অধীনে। সাবর্ণদের সৈন্য, যাঁরা জাতিতে সম্ভবত বাগদি, তাঁরাই এই গৌরীপুরে অঞ্চলে থাকত। তাঁদের আরাধ্যা মা কালীই আজও পূজিতা হচ্ছেন গৌরীপুর কালীবাড়িতে। এই মন্দিরটিতে ১৯৫০ সাল থেকে মা পূজিতা হয়ে আসছেন। অর্থাৎ নবরূপে নির্মিত মন্দিরের বয়স পঁচাত্তর বছর। শোনা যায়, গৌরীপুর কালীবাড়ির এই দেবীকে স্বয়ং রামকৃষ্ণ পুজো করেছিলেন। এই মন্দিরে দেবী আদপে দক্ষিণা কালী। প্রতি সপ্তাহে মঙ্গল ও শনিবার মন্দির লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। বাংলা নববর্ষ, ইংরেজি নববর্ষ, বিশ্বকর্মা পুজো এবং প্রতি অমাবস্যায় দেবীর পুজো হয়। ১৯৫০ সাল থেকে এই মন্দির গৌরীপুর সার্বজনীন কালীমন্দির ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়ে চলেছে।
মন্দিরের দেবী কালীকে ঘিরে রয়েছে নানান জনশ্রুতি, লোক কাহিনি। ধর্মপ্রাণ গিরিশপতি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মন্দির তৈরির প্রধান উদ্যোক্তা। স্থানীয়দের নিয়ে তিনিই মন্দির গড়েছিলেন। বাঁশের চালায় তৈরি মন্দিরে পুজো শুরু হয়। পরবর্তীতে কালীদাস মল্লিক, জনৈক সাধক লালবাবা প্রমুখেরা মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রথমে মাটির মূর্তি মন্দিরে অধিষ্ঠিত ছিল। এখন নিকষ কালো কষ্টিপাথরের মূর্তি গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। গর্ভগৃহের ভিতরে রুপো নির্মিত সুসজ্জিত সিংহাসনের উপর মা অধিষ্ঠান করেন। দেবীর পদতলে থাকেন শিব। পরবর্তীতে মন্দিরের সামনেই তৈরি হয়েছে নাট মন্দির।
মায়ের ভোগের জন্য নিয়মিত পাঁঠাবলি দেওয়া হত। তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন মাকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। মন্দিরের বার্ষিক পুজোর সময় মধ্যরাত্রে মাকে রাজবেশে সাজানো হয়। স্বর্ণালংকারে সেজে ওঠেন দেবী। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন।
নিত্য পুজোয় প্রতিদিন উষালগ্নে দেবীর মঙ্গল আরতি করা হয়। মূর্তিকে নতুন বেশে সাজানো হয়। দুপুরে মাকে অন্নভোগ দেওয়া হয় ও পরে সেই প্রসাদ ভক্ত ও সাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রতি অমাবস্যায় পুজো হয়। প্রতিদিন বিকেলে মাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে পুজো করা হয়। সন্ধ্যা আরতি এই মন্দিরের বিশেষ আকর্ষণ। ঢাক, কাঁসর, ধূপ, পঞ্চপ্রদীপ, শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে সন্ধ্যারতি চলে। মন্দিরের পাশেই গড়ে উঠেছে এক শিবমন্দির। শিবরাত্রিতে বিশেষ পুজো হয়। মন্দিরে চার প্রহরে শিবের আরাধনা চলে। এছাড়াও দেবাদিদেব মহাদেবেরও নিত্য পুজো হয়।