স্থান, মোকাম কলিকাতা। সময়, উনিশ শতকের প্রথম অর্ধ। সে হল গিয়ে বাবুদের রবরবার যুগ। হরেক বাবুর হরেক খেয়ালের কাল। চাদ্দিকে একে-ওকে টেক্কা দেওয়ার হররা।
বৌবাজারের বাবু রাধামোহন সরকার। তাঁর খেয়াল হল, একটা পেশাদার পালাগানের দল খুলবার। যাত্রাপালার দল। হ্যাঁ, সবাই যেখানে শখের নাটক-শখের দল ইত্যাদি 'শখ শখ' করে মরছে, সেখানে এমনটা করতে পারলে সবার মুখে ঝামা ঘষে একটা আনকোরা জিনিস হবে বটে কোলকেতায়।
বাবু রাধামোহনের বজম-ইয়ার বাবু বিশ্বনাথ মতিলাল। শিয়ালদহের বৈঠকখানা বাজারে তাঁর একটি বৈঠকখানা আছে। সেখানে দুই ইয়ারে কষে আড্ডা হয়। সেদিনও হচ্ছিল।
আসলে, তাকিয়ায় কেতরে আয়েশে আলবোলায় বুল বুল করে তামাক টানতে টানতে দুই ইয়ারে ফাঁদছিলেন যে, কত শিগগির কেমন করে পালাগানের দলটি খোলা যায়, কার কোন্ গানের দল থেকে কাকে ভাঙিয়ে আনা যায়, কেমন লোকজন দলে টানলে চটজলদি উঠতি বাবুদের চোখে নতুন কেরামতি দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি...
তা, পাঁয়তারা-ফিকিরের গুলজার যখন দমকে দমকে জমে উঠছিল, ঠিক তারই মধ্যে হঠাৎ হরেক আওয়াজের মাঝে একটি স্বর বিশেষ হয়ে বৈঠকখানা বাজারের গলি থেকে ছিটকে ঢুকে পড়ল গদিতে--‘চাঁপা কলা চাই বাবু, চাঁপা কলা?’!
স্বরটি শুনেই সোজা হয়ে বসলেন রাধামোহন ও বিশ্বনাথ। তাঁদের সমঝদার কানে টংকার দিয়েছে এই স্বর।
আশ্চর্য, ফেরিওয়ালার ডাকে স্বর ছুঁয়ে যাচ্ছে গান্ধার থেকে নিষাদ! মিষ্টি কণ্ঠে সপ্তসুরের খেলা! গলা শুনে মনে হচ্ছে বছর বিশের ছোঁড়া-টোড়া হবে। ক্ষণিকের মধ্যে বিস্মিত চোখে দুই ইয়ারের কথা হয়ে গেল। যে-করেই হোক ব্যাটাকে চাই! কিন্তু, তারই মধ্যে স্বরটি দোর পেরিয়ে চলে গেছে বেশ কিছুটা দূরে। বাবু বিশ্বনাথ অমনি হাঁক পাড়লেন চাকরকে, 'এই কে আছিস! যা, কলাবেচা ছোঁড়াটাকে এক্ষুনি ডেকে নিয়ে আয়!'
গলির মোড় থেকে ছোঁড়াকে ডেকে আনা হল।
মাথায় ঝাঁকাভরা চাঁপা কলার ফেনি। হ্যাঁ, যা ভাবা গিয়েছিল তাই; ছোঁড়ার বয়স বছর বিশের বেশি না। বেঁটেখাটো রোগা-প্যাংলা চেহারা অথচ মিষ্টি দেখতে। এ-বয়সেও মুখে দাঁড়িগোঁফের তেমন বালাই নেই। মেয়ে সাজালে দারুণ মানাবে। খুঁত বলতে কথায় বড্ড ওড়িয়া টান।
হঠাৎ অমন খাতির করে ডাকায় ছোঁড়া বেশ অবাকই হয়েছিল। তার মতো বেচে-খাওয়া মানুষকে কোন্ বাবু আর খাতির করে কবে গদিতে ডেকেছে! তার ওপর বাবুর চাকরেরা যখন ঝাঁকা নামিয়ে বসতে দিল, খাতির করে বাবুরা যখন জল-বাতাসা দিতে বললেন; তখন তার বিস্ময়ের আর অবধি রইল না।
আপ্যায়নের মাঝেই অবশ্য বাবুরা বিস্ময়-ছোঁড়াটির সঙ্গে চালিয়ে যেতে লাগলেন আলাপ। আলাপ মানে, একতরফা জেরা। সেই জেরায় জানা গেল, উৎকল প্রদেশের জাজপুরে ছোঁড়ার বাড়ি। গরীবের ছেলে। বাপের নাম, মুকুন্দ। নিজেরা তিন ভাই। জমি সামান্যই। তার ওপর এই বয়সেই বিয়ে করে বসে আছে। নিজে খাবার উপায় নেই, তায় 'শঙ্করাকে ডাক'-এর মতো ওই কাণ্ডটি ঘটিয়ে একেবারে ল্যাজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি ফেলেছে!
ফল যা হবার তাই হয়েছে। দেশের ওই সামান্য জমিতে আদা-বেগুন চষে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও কিছুতে দিন চলছিল না। তাই দুত্তোর বলে পেটের টানে সুদূর উৎকল-প্রদেশ থেকে ছুটে এসেছে কলকাতায়। হালে কলা বেচে পেট চলে। নাম, গোপাল। আর, গানটান? নাহ, বাপের জন্মে শেখেনি; তিনকুলে ওসবের চাষই নেই।
শেষের কথা ক'টি শুনে দুই স্যাঙাত তো অবাক! 'বল কী, তোমার গলায় রেওয়াজি সুর শুনলুম যে!...নাহ, এ তো হেলাফেলার কথা না। তাহলে তো বলতে হয়, তুমি মা সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র হে!'
যাই হোক, নামানো ঝাঁকা আর গোপালকে মাথায় তুলতে হল না। এদিন থেকেই তার কলা বেচা বন্ধ হল। রাধামোহনের হবু যাত্রার দলে তার চাকরি হয়ে গেল। বেতন মাসে দশ টাকা। এখন কোন কাজ নেই, খালি খাও-দাও, বাংলা শেখো, অভিনয় শেখো আর গলায় গান তোলো।
বাবুর বাঁধা গানের মাস্টার হরিকিষণ মিত্র লেগে পড়লেন তাকে নিয়ে। সারেগামা সাধতে হল না, তালিম শুরু হল একেবারে ঠুংরি দিয়ে। গান-অভিনয় আর ভাষা শিক্ষার রগড়ানি চলল প্রায় দু'বছর ধরে। গোপালের নেবার ক্ষমতা এত চমৎকার ছিল যে, আর-সবার থেকে সে সবেতেই চৌকস হয়ে উঠল সহজে।
সেকালে ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের 'বিদ্যাসুন্দর' অংশটিকে পালায় রূপান্তর করে অভিনয় করানোর খুব হুজুগ উঠেছিল শখের বাবুদের মধ্যে। বাইরে ও অন্দরে সেই অভিনয় বেশ কদরও পাচ্ছিল। কাজেই, রসিক ও ইয়ারদের পরামর্শে সেটি নিয়েই মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবু রাধামোহন।
বায়না পেয়ে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণের বাড়িতে প্রথম আসর বসল। গোপাল সাজল মালিনী। গানে ও অভিনয়ে সে এমন আসর মাত করল যে, লোকে যেন মন্ত্রবলে মুগ্ধ হয়ে কেবলই ধন্য ধন্য করতে লাগল। ফলে, এক আসরেই বাবু রাধামোহনের দলের এবং গোপালের এমন সুখ্যাতি হল যে, নগর কলকাতায় বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল। বাবু খুশি হয়ে এক লাফে গোপালের বেতন পঞ্চাশ টাকা করে দিলেন।
কিন্তু, এই সুখ্যাতির সুখ বাবুর বেশিদিন সইল না। হাটখোলার দত্ত বাড়ি এবং সিমলের ছাতুবাবুর বাড়ির আসরে ওই 'বিদ্যাসুন্দর' পালাগানের মধ্য দিয়েই ফের জোড়া হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড ঘটিয়ে রাধামোহন হঠাৎ মারা গেলেন।
বাবু মরলেন, বাবুর শখের দলও মরল। অর্থাৎ, ভাঙল। যারা সুখের পায়রা তারা তো যাবেই। তারা গেল। যারা রইল তাদের নিয়ে দল গড়ল গোপাল।
দল না-গড়ে গোপালের আর কোন উপায় ছিল না। বাংলা ভাষার সুধা তখন অন্তরে, বিদ্যাসুন্দরের স্বাদ তখন অন্তরে, আসর মাতিয়ে আরও সুখ্যাতি পাবার সাধ অন্তরে, তাই গড়ে উঠল নতুন দল। সে দল হল গোপালের নিজস্ব।
অভিনয় করতে করতে সাধারণ মানুষের রুচি বেশ ভালোভাবেই বুঝে নিতে পেরেছিল বিচক্ষণ গোপাল। বুঝেছিল যে, নিছক বড়লোক বাবুদের মুখাপেক্ষী হয়ে সে দল চালাতে পারবে না; তাকে সাধারণের উঠোনে পৌঁছতে হবে।
তাই, বিদ্যাসুন্দরের গল্পটাকে গোপাল একেবারে নিজের ছাঁচে ঢেলে সমস্ত জটিলতা ছেঁটে জলের মতন সহজ করে নতুনভাবে লিখে ফেলল। কালোয়াতি ছেড়ে সহজ সুরে সরল ভাষায় গান তৈরি করল। ফলে, তার 'বিদ্যাসুন্দর' রাজকীয়সভা ছেড়ে একেবারে বারোয়ারি আসরের উপযোগী হয়ে উঠল। এবং, অচিরেই লোকসাধারণের চিত্তহরণ করে ফেলল।
গোপালের লেখা একটা গানের নমুনা দিই--তাহলেই বুঝতে পারবেন যে, বাংলা ভাষায় তার কতটা দখল ছিল, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের প্রতি সে কতটা সচেতন ছিল, স্বদেশ ও সমাজ সম্পর্কে সে কতটা সচেতন ছিল; যে সচেতনতা সময়ে সময়ে অতিক্রম করে গেছে দেশ-কালের সীমা...
"জিজ্ঞাসি তোমারে হে রাজন্, শুনি তব বিবরণ।
রাজকার্য্য কি এমনি ধারা, এই কি আচরণ।।
যেমনি মন্ত্রী তেমনি পাত্র, দেখি কেবল নামমাত্র।
সবাই কি এক গুরুর ছাত্র, তারাই বা কেমন।।"
এভাবেই মনোরঞ্জক প্রতিভার জোরে ও শিল্প দিয়ে জনসংযোগের ক্ষমতায় গোপাল সমস্ত বারোয়ারি পুজো-পার্বন-উত্সব-অনুষ্ঠানের আসরে জোরকদমে বায়না পেতে লাগল। হয়ে উঠল ছেলেবুড়ো সবার প্রিয় সেলিব্রেটি, 'গোপাল উড়ে'।
প্রায় দু'দশক ধরে রসিক শ্রোতাদের পালা ও সঙ্গীতরসের ভিয়েনে মজিয়ে রেখে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে গোপাল উড়ে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু, মৃত্যুর পর আরও কয়েক দশক ধরে নানান উত্তরসূরীর সূত্র ধরে তামাম কলকাতার রসিক মানুষের মনে তিনি বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন। এখনও অবশ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে বেঁচে রয়েছেন বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসের পাতায়। সেই ইতিহাস বারে বারে মনে করিয়ে দেয় যে, চৈতন্যের যুগে খোলাবেচা শ্রীধর চৈতন্যের ছোঁয়ায় মুক্তি পেয়েছিল, আর কলাবেচা গোপালের ছোঁয়ায় মুক্তি পেয়েছিল বাংলার পালাগান।