সাফল্যের খিদেটাই সিন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি

শেষ অব্দি শেষ দিনে সোনা পেলেন পুসারলা ভেঙ্কটা সিন্ধু। ২০১৮তে গোল্ড কোষ্ট কমনওলেথে মিশ্র দলে সোনা পেলেও একক বিভাগে সোনা ছিল অধরা। ২০১৯-এর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে একক ভাবে সোনা জেতার পর ২০২২ বার্মিংহাম কমনওয়েলথস গেমসের মহিলাদের একক বিভাগে এই প্রথম সোনা পেলেন। ফাইনালের শুরু থেকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল দুই প্রতিযোগীর মধ্যে। সোনার লড়াইয়ে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি ছিলেন না কেউই।

২০১৪ গ্লাসগোয় ব্রোঞ্জ, ২০১৮ গোল্ড কোস্টে রুপো এবং ২০২২ বার্মিংহামে সোনা, পিভি সিন্ধু অবশেষে কমনওয়েলথ গেমসে যা চেয়েছিলেন তা অর্জন করেছেন। কিন্তু হলুদ ধাতু সিন্ধুর জন্য সহজ ছিল না। মাল্টি-স্পোর্ট ইভেন্টে শীর্ষ পুরস্কার দাবি করতে তার তিনটি প্রচেষ্টা, ১৩ বছরের পরিশ্রম এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

সোমবার, বিশ্বের সাত নম্বরে থাকা কানাডার ১৩তম র‌্যাঙ্কের মিশেল লিকে ২১-১৫, ২১-১৩ ব্যবধানে পরাজিত করে এনইসি স্টেডিয়ামে তার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ ঘটল। অলিম্পিক গেমস, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস এমনকি দক্ষিণ এশিয়ান ফেডারেশন গেমস সহ বহু-শৃঙ্খলা গেমসে এটি তাঁর প্রথম সোনা।

সাত্ত্বিক সাইরাজ রঙ্কিরেড্ডি এবং চিরাগ শেট্টিদের ইংলিশ প্রতিপক্ষ বেন লেন এবং শন ভেন্ডিকে ২১-১৫, ২১-১৩এ পরাজিত করে পুরুষদের ডাবলসে সোনা জয় এবং প্রথম মাল্টি-ডিসিপ্লেন্ড গেমসে লক্ষ্য সেনের সোনার অভিষেক আজকের দিনটা ভারতীয় ব্যাডমিন্টকে স্মরণীয় করে রাখল। এই প্রথম ভারত কমনওয়েলথস গেমে পুরুষ এবং মহিলা উভয় একক জিতেছে। এই তিন স্বর্ণপদক একসঙ্গে দলগত ফাইনালে মালয়েশিয়ার কাছে বেদনাদায়ক হার মুছে দিল খানিকটা। খেলা শেষের পর স্কোরলাইনে দ্বিতীয় হওয়া মিশেল লি সিন্ধুর উদ্দেশ্যে বলছিলেন, "সিন্ধু আজ খুব ভাল খেলেছে। ২০১৪ সালে কমনওয়েলথ গেমসে আমরা প্রথম দেখা করার পর থেকে আট বছরে, ও আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আমার মনে হয় আমি ভালো খেলেছি। কিন্তু সিন্ধু অনেক ভালো ছিল।" দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা হবার সময় সিন্ধু নিজের ১১তম পয়েন্ট তোলার জন্য লিকে প্রায় ধূলিসাৎ করেন। বিশ্বের ১৩ নম্বর মিশেল ২০১৪ সালে গ্লাসগোয় আয়োজিত কমনওয়েলথ গেমসে সিঙ্গলসে সোনা জিতেছিলেন। যদিও তাঁর সংগ্রহে সিন্ধুর মতো অলিম্পিক্স পদক নেই। একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, শেষ বার সিন্ধু মিশেলের কাছে হেরেছিল ২০১৪ সালে গ্লাসগোতে। তার পরে ছ'বারই সিন্ধু টানা হারিয়েছিলেন।

মাল্টি-ডিসিপ্লিন গেমস থেকে সিন্ধুর প্রথম সোনার পদকটি বারবার তাঁকে ছুঁয়েও নাগালে আসছিল না, যদিও তিনি নিজেই উল্লেখ করেছিলেন যে তার একটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অন্যান্য শিরোপা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত স্বস্তি প্রকাশ হয় যখন তিনি তার হাত ছুঁড়ে দেন দর্শকদের দিকে এবং তারপরে তার কোচ পার্ক টে সাংকে জড়িয়ে ধরেন। 

এই মিশেল ২০১৪ সালে তার অভিষেক ম্যাচে সিন্ধুকে সেমিফাইনালে হারিয়েছিলেন। জয়ের পর রোমাঞ্চিত সিন্ধু স্বীকার করেছেন, "আমি এখন অনেক দিন ধরে এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশ্যই আমি খুব খুশি। অবশেষে আমি পেরেছি। প্রথম দিন থেকেই আমার গতি এবং আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমি পারি"।

বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস শুরু হওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছিল, এ বার পি ভি সিন্ধু নিশ্চয়ই সোনা জিতবে। এর আগে দু'বার যা ওর অধরা থেকে গিয়েছিল। প্রায় ১০ বছর আগে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং-এর শীর্ষ ২০ তে স্থান করে নেওয়া ১৭ বছর বয়সি সিন্ধু তখন থেকেই খেলার জগতে নিজের নামের একটা স্থান সংরক্ষণ করার কথা লিখে ফেলে। গতকালের ফাইনালে খাতায়কলমে এগিয়ে থেকেই শুরু করেছিলেন সিন্ধু। যদিও তাঁকে কড়া চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হল। দু'জনের মধ্যে একাধিক লম্বা র‌্যালি হল। কখনও জিতলেন সিন্ধু। কখনও মিশেল। প্রথম গেমে সমানে সমানে লড়াই হল। সিন্ধু ১৮-১৪ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পর আর স্নায়ুর চাপ ধরে রাখতে পারলেন না কানাডার প্রতিযোগী। একাধিক ভুল করলেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২১-১৫ ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে নেন ভারতীয় প্রতিযোগী। সত্যি বলতে সিন্ধু এবারের অপরাজিতও। এবারের প্রতিযোগিতায় মিক্সড টিম রুপো পেলেও সিন্ধু জিতেছিলেন।

এ বারের কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দল নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক প্রত্যাশা ছিল। তার একটা কারণ গত বারের প্রতিযোগিতায় মিক্সড টিম সোনা জিতেছিল। তা ছাড়া এ বারের দলটাও খুব শক্তিশালী। প্রথম বার টমাস কাপ জেতার আত্মবিশ্বাস নিয়েও বার্মিংহামে নেমেছিল দলটা। তাই মিক্সড টিম তো বটেই, সিঙ্গলস আর ডাবলসেও আমরাই এ বার দাপট দেখাব সেই আশা ছিল।

সিন্ধুর সব থেকে বড় গুণ, নিজেকে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাওয়া। অলিম্পিক্সের দুটো পদক ছাড়াও ব্যাডমিন্টন বিশ্বে সব বড় প্রতিযোগিতাতেই সিন্ধুর পদক রয়েছে। তাও যখনই সিন্ধু নতুন কোনও টুর্নামেন্টে নামে ওকে একই রকম ক্ষুধার্ত মনে হয়। সাফল্যের এই খিদেটাই সিন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি। না হলে বিশ্ব ব্যাডমিন্টনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বছরের পর বছর নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে পারত না। যে কোনও খেলাধুলোর ক্ষেত্রেই শীর্ষে ওঠা সহজ, কিন্তু সেই জায়গাটা ধরে রাখা অনেক বেশি কঠিন। সিন্ধুর আর একটা বড় গুণ হল ঠিক সময়ে জ্বলে ওঠা। বিশেষ করে বড় প্রতিযোগিতাগুলোতে। সিন্ধুর এই গুণগুলোই আমাদের তাতায়। তাই আগামী অলেম্পিকে সোনার খিদে সিন্ধুর সাথে আমাদেরও শুধু থাকছেনা, দিনদিন তা বাড়ছেও।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...