‘আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ’। না। প্রেমে পড়া বারণ নয়। ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা এ ভুবনে কে কখন ধরা পড়ে কে জানে’! প্রেমের কোনও বয়স নেই। যে কোনও বয়সেই প্রেমে পড়া যায়। কথায় বলে প্রেমে পড়লে নাকি মানুষের চেহারা বদলে যায়। সামনেই তো ভ্যালেন্টাইন ডে। কিন্তু বাঙালির ভ্যালেনটাইন্স ডে সরস্বতী পুজো তো পেরিয়ে গেল। কিন্তু ভালোবাসার কি কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ হয়? কোনও বিশেষ দিন ধরে কি বলা যায় যে আমি তোমাকে ভালবাসি? তবু এত অসংখ্য নর-নারীর প্রেমকে শ্রদ্ধা জানাতেই একটা বিশেষ দিনকে উৎসর্গ করা হয়েছে প্রেম দিবস হিসেবে।
বর্তমান প্রজন্ম হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুক, নিদেন পক্ষে টেক্সট মেসেজেই অভ্যস্ত। এগুলোর মাধ্যমেই তারা প্রেমে পড়ে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের ভালোবাসা আবর্তিত হয়। আবার সেই প্রেম ভাঙতেও বেশি সময় লাগে না। যন্ত্র থেকে মোছা মানেই মন থেকেও মুছে গেল। কিন্তু যখন এই মোবাইল নামক বস্তুটি বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি তখন প্রেম কীভাবে হত। অর্থাৎ এই প্রজন্মের পূর্বসুরীরা কি প্রেম করতেন না? নিশ্চয়ই করতেন। চলুন একটু ঘুরে আসা যাক সেই ফেলে আসা প্রেমের অতীতে।
সময়টা আট এবং মূলত নয়ের দশক। মোবাইল তখন ভিন গ্রহের প্রাণী। খুব উচ্চবিত্ত বাড়িতে এক-আধটা ল্যান্ডফোন থাকত। সেটা সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাহলে প্রেমটা হত কীভাবে? প্রেমের প্রথম ধাপ হল পূর্বরাগ। একটু আড় চোখে দেখা, আলতো ইশারা, প্রেমের পরশ গায়ে মেখে একটু পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া-এইসব। বুকের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে অনুভূতি। ক্লাসে ঢোকার মুখে বা শেষ হবার পর এক মুহূর্তের জন্য যদি তাকে একা পাওয়া যায়! কিছুই বলা হত না। শুধু ‘তোর কেমিস্ট্রির খাতাটা যদি দিতিস…।’ ব্যাস! এইটুকু বলতে পারলেই জীবন ধন্য। তার পর সারা রাত জেগে রবি ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’ খুঁজে খুঁজে গানের চারটে লাইন কেমিস্ট্রি খাতার পিছনে। ভাবটা এমন যেন সে নিজেই লিখেছে। পরের দিন দুরুদুরু বুক। কীভাবে খাতাটা ফেরৎ দেওয়া হবে। যার খাতা তাকে ফেরৎ দিতে গিয়েই গলদঘর্ম অবস্থা। কিন্তু কেন? কারণ সেখানে গানের ভাষায় এক মুঠো স্বপ্ন উপহার দিয়েছে এক কিশোর। সে কী বুঝবে সেই চারটে লাইনের মানে!
তার পরের ধাপ চিঠি। এই চিঠিই ছিল প্রেমের মূল ইউএসপি। সেখানে কাব্যিক ভাষায় কত রোমান্টিক কথা থাকত। অনেকেই প্রেমের ভাষা জানত না। ক্লাসে দু-একটি ছেলে বা মেয়ে থাকত যাদের ভাষার ওপর বেশ ভাল দখল। তখন তার স্মরণাপন্ন হয়ে তাকে দিয়েই চিঠি লেখানো হত। প্রেমের চিঠি লেখার জন্য তার কদর বেড়ে যেত। আর যাদের কপালে তেমন বন্ধু জুটত না তারা স্মরণাপন্ন হত চিরন্তন প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ অথবা জীবনানন্দর। নিজের কথার ফাঁকে ফাঁকে কোথাও এক টুকরো রবি ঠাকুর কোথাও জীবনানন্দ উঁকিঝুঁকি দিতেন।
চিঠি তো লেখা হল। কিন্তু দেওয়া হবে কীভাবে? কখনও খাতার ভেতরে, কখনও ছুঁড়ে। কখনও বা বিশ্বস্ত কোনও বন্ধুর হাত ধরে। তারপর দুরুদুরু বুকে প্রতীক্ষা। কখনতার উত্তর আসবে। আবার সেই চিঠিকে বিশেষ চিঠি করে তোলার জন্য কত কাণ্ডই না করা হত। কেউ সেই চিঠিতে মিশিয়ে দিত সুগন্ধী। কেউ বা ভেতরে দিত ঝাউ পাতা। কেউ আবার উগ্র প্রেমে বিশ্বাসী ছিল সে তার প্রেমিকাকে কত ভালোবাসে বোঝানোর জন্য রক্ত দিয়ে চিঠি লিখত।
তখন বিভিন্নরকম নক্সা করা বা গোলাপ ফুলের ডিজাইন করা চিঠির প্যাড পাওয়া যেত। সেই প্যাডেও প্রেমপত্র লেখা হত।
তারপর আসত সেই বিশেষ প্রেমের দিন। তখন গ্রিটিংস কার্ডের খুব রমরমা। নিউ ইয়ার হোক বা ভ্যালেনটাইন্স ডে। কার্ডের দোকানে লম্বা লাইন। গ্রিটিংস কার্ডের জন্য তখন বিখ্যাত ছিল আর্চিস গ্যালারি। সেখান থেকে বিশেষ মানুষটির জন্য কার্ড কেনা হত। একটা কার্ড কিনতেই পকেটের শোচনীয় অবস্থা। তাতে কীই বা আসে যায়! দুদিন টিফিন নাই বা খেলাম। তবু ‘সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা’। যাদের পকেটের অবস্থা একটু ভালো তারা অবশ্য কার্ডের সঙ্গে কিনত কখনও টেডিবিয়ার, কখনও ক্যাডবেরি।
তবে বাড়িতে ধরা পড়লে আর রক্ষে থাকত না। সেই প্রেমপত্র একবার যদি বাবা বা দাদার হাতে পড়ে তাহলে আর রক্ষে নেই। মেয়েটির বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করতে বাড়ির লোকের বেশি সময় লাগত না। ঘোষণা করা হত খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। আর সেই ছেলেটিকে হাতের কাছে পেলেই তার ঠ্যাং খোঁড়া করে দেওয়া হবে- এমন নিদানও দেওয়া হত। তখনকার দিনে জীবনযাত্রা এত সহজ ছিল না। গুরুজনদের যমের মতো ভয় খেত বাড়ির ছোটরা। তাই খুব সন্তর্পণেই তাদের প্রেম করতে হত। বাড়ির মেয়েদের এমন ভাবে শিক্ষা দেওয়া হত যেন তারা খুব সযত্নে নিজের শরীর ও মনকে প্রদীপ শিখার মত আঁচলে আড়াল করে রাখে সেই বিশেষ একজনকে আলোকিত করার জন্য। অন্য কেউ যেন তার শিখাটুকুও দেখতে না পায়।
এখন আমাদের জীবন থেকে একটা জিনিস অবশ্য কর্পূরের মত উবে গেছে। সেটা হল প্রেমের জন্য অপেক্ষা। প্রেম এখন ‘ইন্সট্যান্ট’। গড়তে যতটা সময় লাগে, তার চেয়েও কম সময় লাগে ভাঙতে। কিন্তু তখন প্রেমের প্রতীক্ষাটাই ছিল আসল। রোদের মধ্যে বৃষ্টির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশেষ মানুষটির জন্য অপেক্ষা করার যে আনন্দ সে বলে বোঝানোর নয়। তারপর কয়েক মুহূর্ত পাশে পাওয়া। হাতে হাত ঠেকা। তাতেই জীবন ধন্য।
আর তারপর যখন কারও কারও বাড়িতে টেলিফোন এল, তখন বান্ধবী সাজিয়ে বোনকে দিয়ে ফোন করানো হত। তখন থেকে শুরু হল টুকটাক ফোনালাপ, প্রেমালাপ। ইন্টারনেটের হাত ধরে যখন থেকে দ্রুত বদলে যেতে লাগল আমাদের চারপাশটা সেই ছবিতো সকলেরই পরিচিত। পুরনো দিনের ছায়াছবিতেও এমন মিষ্টি মধুর প্রেমের দৃশ্য দেখা যায়। কে ভুলতে পারে সাড়ে চুয়াত্তরের উত্তম সুচিত্রার সেই পত্রালাপের প্রেম, আর ওপরে নীচে টরেটক্কার গল্প!