বই। জীবন বদলে দেওয়ার এক বিস্ময়কর চাবিকাঠি। জীবনের পথ সবসময়ই অনন্ত ছুঁতে চায়। কখনও তা আমাদের বোঝার গন্ডীর মধ্যে, কখনো আবার সেই গন্ডির বাইরে। বিপরীত স্রোতে বয়ে চলা সময় যদি দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়, কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ায় রূপকথার মতো। সেই দুঃসাহসী মানুষগুলো তখন ঝাড়বাতি হয়ে ওঠে অন্য সকলের কাছে। তাঁদের জীবন আলোর দিশা দেখায় অন্য মানুষদের। এমনই এক স্বপ্নসন্ধানী মেয়ে অবনী লেখারা।
এ বছরের টোকিও প্যারালিম্পিকে অবনী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। প্রথম মহিলা খেলোয়াড় হিসেবে জিতে নিয়েছেন সোনা। রাইফেল শুটিং বিভাগে তিনি সোনা জিতেছেন। তবে শুরুটা এত সহজ ছিল না।
এগারো বছর বয়সে ভয়াবহ এক গাড়ি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় অভনী। স্পাইনাল কর্ড মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সারা জীবনের মতো সঙ্গী হয় হুইল চেয়ার। ভেবেছিলেন জীবন বোধহয় মুখ ফিরিয়েছে। পাথুরে, অসহায় এক রাস্তা ছাড়া কোন কিছুই সামনে ছিল না তখন।
কিন্তু পরিবার সঙ্গ দিয়েছে তাঁদের মেয়েকে। উৎসাহ দিয়ে গেছেন জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে। কোন বিষয় থেকে বিরত রাখেন নি অবনীকে। হঠাৎ করেই অবনীর হাতে আসে একটা বই। ''আ শট অ্যাট হিস্ট্রি''। বিখ্যাত বন্দুকবাজ অভিনব বিন্দ্রার আত্মজীবনী। অলিম্পিকে সোনা জেতা অব্দি এই খেলোয়াড়ের জীবনের পথ উদ্বুদ্ধ করে অভনীকে।
সেই সময়ে অবনী লেখারা খেলাধুলা নিয়ে চর্চা শুরু করে দিয়েছেন। তিরন্দাজী এবং রাইফেল শুটিং দুই ক্ষেত্রেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন তিনি। তবে অভিনব বিন্দ্রার আত্মজীবনী তাঁকে শুটিং এর দিকে এগিয়ে দেয় অনেকটা। এই ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত এক মেয়ের জীবন বদলাতে শুরু করে একটু একটু করে। প্রথমবার আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন ২০১৭ সালে। এই সাহসী মেয়ে ভারতকে এগিয়ে দিয়েছেন তাঁর খেলার মাধ্যমে। বর্তমানে ১০ মিটার রাইফেল শুটিং বিভাগে তাঁর ক্রম পঞ্চম।
২০০১ সালের ৮ই নভেম্বর রাজস্থানের জয়পুরে জন্ম অভনীর। ২০১৫ সালে জয়পুরের জগৎপুরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে প্রথমবার রাইফেল শুটিং শুরু করেন অবনী। বর্তমানে তিনি সুমা সিদ্ধার্থ শিরুর কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ২০১৭ সালে প্যারা-চ্যাম্পিয়নশিপের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন হয়ে। তারপর এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা ছিল প্রবল। ২০১৯ সালে তাঁকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে সম্মানিত করা হয়।
তবে এরপর খেলা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কোভিডের জন্য। তাঁর শরীরের নিম্নাঙ্গ অসাড়। তাই প্রতিদিন ফিজিওথেরাপি চলে। তবেই পা সামান্য ওঠানামা করাতে পারেন অবনী। অতিমারির সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর এই ধারাবাহিক চিকিৎসা। এতকিছুর পরেও হার মানেনি এই স্বপ্নকন্যা।
টোকিও প্যারালিম্পিক্স তাঁর কাছে স্বপ্নের হাতছানি। পাখির চোখ রেখে এগিয়েছিলেন এর জন্য। কোভিড পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই নতুন উদ্যমে নেমে পড়েছিলেন প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষেত্রে। তারপর ইতিহাস ছোঁয়া ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। এবছরের টোকিয়ো প্যারা অলেম্পিক্সে প্রথমবার কোনো মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে ১০ মিটার রাইফেল শুটিং-এ সোনা জিতে নিয়েছেন।
তবে স্বপ্ন-ছোঁয়া পথে অপেক্ষা করেছিল আরো ম্যাজিক। প্রথমবার কোনো ভারতীয় প্যারা-অ্যাথলিট হিসেবে তিনি জিতে নিয়েছেন দুটি পদক। ৫০ মিটার রাইফেল শ্যুটিং বিভাগে জিতেছেন ব্রোন্জ। প্যারা-অলিম্পিক্সের ইতিহাসে এ নজির অনন্য। ইতিহাসসৃষ্টিকারী। এর আগে ২০১৬-র এশিয়ান গেমসে সাঁতারু প্রশান্ত কর্মকারও দুটি পদক জিতেছিলেন।
পরিশ্রম, অধ্যাবসায় যেকোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার থেকেই অনেকটা বড়। হাজার অন্ধকারের মধ্যেও আলো ছড়াতে পারে। স্বপ্ন আর জীবনের পথে অবনী আরো ইতিহাস স্পর্শ করবে, সারা ভারতবাসী এমনটাই আশা করছে।