দেবী কালিকার এমন অনেক রূপ-ই রয়েছে, যা সাধারণ গৃহস্থের জন্য নয়। অর্থাৎ বাড়িতে দেবীর এই সমস্ত রূপের আরাধনা করা যায় না। শ্মশানকালী এমনই এক রূপ। কালীমাত্রেই শ্মশানের দেবী। তবে শ্মশানকালী নামেই আন্দাজ করা যাচ্ছে, দেবী কালিকার এই রূপটি কেবলমাত্র শ্মশানঘাটেই পূজ্যা। শ্মশান কথাটির অর্থ হল মৃত স্থান। চলতি কথায় যেখানে সব দাহ করা হয়। করালবদনী আদ্যা শক্তি মায়ের বিচরণক্ষেত্র। মা কালীকে ধ্বংসের দেবী বলে। এই ধ্বংস মানে সর্বনাশ করা নয়। এর অর্থ তিনি নিজেই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন। কালী পুজো করার অর্থ হল মানুষ তার শেষ জীবনে মায়ের কোলে আশ্রয় পায় এবং তাতে সে অসীম শান্তি ও আনন্দ পায়। শ্মশান মন্দিরের মতোই পবিত্র। মন্দিরের শাস্ত্র পাঠ করে দেহের পরিণামের কথা বলা হয়। সেটার জীবন্ত উদাহরণ স্বচক্ষে দেখা যায় শ্মশানে গেলে। তাই শ্মশান মা কালীর এত প্রিয় স্থান। তাই বলা যেতে পারে শশ্মানেই মা কালী তার মনের মতো করে পূজিত হন। শাক্ত উপাসকরা মা কালীকে এই শশ্মানেই আরাধনা করে থাকেন।
দেবী কালীর অনেক রূপের মধ্যে শ্মশানকালী ভয়ঙ্কর। আদ্যাশক্তি মহামায়ার আটটি রূপ – দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, উগ্রকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী এবং চামুণ্ডাকালী। দেবী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, নৃমুণ্ডমালা বিভূষিতা। তিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা বা শ্যামাঙ্গী। দেবীর রূপ দিগম্বরী। তিনি ত্রিনেত্রা, উন্নতদন্তা এবং শবরূপী মহাদেবের হৃদয়োপরি অধিষ্ঠিতা। তিনি 'কাল' অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী, পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক বলেই দেবীর নাম 'কাল' যুক্ত 'ঈ' – 'কালী'। 'ঈ' কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ হয়েছে 'ঈশ্বরী' বা সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার জন্য। এ সব অত্যন্ত গুরু তত্ত্ব। শাক্ত মতে বা তন্ত্র মতে এর অনেক গভীর ব্যাখ্যা রয়েছে।
মা কালীর গলায় ঝুলছে পঞ্চাশটি মুণ্ডমালা এবং বাঁ হাতে একটি মুণ্ডমালা। মায়ের দক্ষিণ হস্তে বরাভয়। নৃমুণ্ড হল চেতনশক্তির আধার। সৃষ্টির তরঙ্গের প্রতীক। মায়ের আলুলায়িত কেশ তাঁর প্রচণ্ড তেজ ও শক্তির প্রতীক। তিনি বিবসনা, কারণ অনন্ত অসীমকে বসন দিয়ে আবৃত করে সীমার সঙ্গে অসীমকে সীমায়িত করা কখনওই যায় না। মা কালীর প্রসারিত জিহবা হল 'খেচরিমুদ্রা'র প্রতীক, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভারসাম্য রক্ষা করে। আদ্যাশক্তি স্বয়ং জীব ও জড়ের কেন্দ্রীভূত লীলার লীলাময়ী। তিনি যেন বহুরূপীনি তাঁকে ঘিরে তৈরী হয়েছে শাক্ত সাধকদের এক আকাঙ্খিত বৃত্ত।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'কালী দ্য মাদার'-এ লিখেছেন, "নিঃশেষে নিভেছে তারাসমূহ, মেঘ এসে আবরিছে মেঘে, স্পন্দিত ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণিবায়ু বেগে। লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরাণ বহির্গত বন্দিদশা হতে, মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে। কালী করাল নাম তোর, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে, তোর ভীমচরণ নিক্ষেপে প্রতি পদে ব্রহ্মাণ্ড বিকাশে। মা কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে"। অপূর্ব নিবেদিত অনুভবের আবাহন। সাধক কাজী নজরুল ইসলাম গেয়ে উঠলেন, "কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন"। কালী নিয়ে সাধক রামপ্রসাদ থেকে শুরু করে কমলাকান্ত কত পদ লিখে গেছেন।
শাক্তধর্ম মতে তিনিই শাক্ত যিনি 'শক্তি'র উপাসনা করেন। যে 'শক্তি'র আধার কোন পুরুষ নন, নারী। পরব্রহ্ম 'দেবী'ই এক এবং অদ্বিতীয়। অন্য সব দেব-দেবীই সেই 'শক্তি'দেবীর অধীন। প্রাণীকুলের জীবন যাপনের তিনিই কারণ। বাঙালি শাক্ত কবিদের তন্ত্র মতে শাক্ত সাধনার রহস্য এই যে তাঁরাও তন্ত্র আর শাক্ত সাধনার তফাৎ করেননি। কার্যত তন্ত্র সাধনা আর শাক্তসাধনা একই। দার্শনিক প্রশ্নে শাক্ত দর্শনের আশ্রয় ছিল সাংখ্য দর্শন। কালে কালে ব্রাহ্মন্যবাদের হাতে পড়ে তন্ত্র ও শাক্ত দর্শনের পরিবর্তন হয়। বৈদান্তিক দ্বৈত ও অদ্বৈত মতবাদ দ্বারা শাক্ত ধর্ম প্রভাবিত হয়। শাক্ত দর্শনের মূল কথা হল, " চরম সত্ত্বা, যা দেশ, কাল ও কারনাতীত বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরুপ, প্রকাশরূপে বর্তমান। বিমর্শশক্তি এই প্রকাশেরই ক্রিয়া সম্পর্কীয় স্বাতন্ত্র্য, যদিও প্রকৃতপক্ষে এই শক্তি তাঁর স্বরুপ অর্থাৎ চরম সত্তার সঙ্গে অভিন্ন। তাঁরই মধ্যে নিহিত, এবং তাঁরই অবিচ্ছেদ্য গুণরূপে প্রকাশিত। শক্তির দুটি অবস্থা আছে – নিষ্ক্রিয় এবং ক্রিয়াশীল। শক্তি যখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে তখন বলা হয় যে বিমর্শ প্রকাশে লীন হয়ে গেছে। কিন্তু শক্তি যখন জাগ্রত তখন চরম সত্তাও স্বয়ং চেতন হন। তখন তাঁর আত্ম জ্ঞান অহমরূপে আত্মপ্রকাশ করে। সমগ্র বিশ্বজগৎ দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিচ্ছবির ন্যায় এই অহমে প্রতিফলিত হয়। চরমসত্তা যার প্রকাশ শিব এবং বিমর্শ শক্তি, একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। দুয়ে মিলে এক অখণ্ড সত্ত্বা। এই চরম সত্তার সঙ্গে শক্তি বা কলা চিরকালীন ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছেন।"
মূলত প্রকৃতি পুরুষ তত্ত্বই শাক্তধর্মের আশ্রয়। শাক্তধর্মে 'তন্ত্র' ও 'সাংখ্য দর্শনে'র প্রভাব অপরিসীম। "জীব সৃষ্টির মূলে নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্ক বর্তমান, এই মূল ধারনার যে দার্শনিক ও আনুষ্ঠানিক অভিব্যাক্তি তন্ত্রে ও সাংখ্যে ঘটেছে তা প্রাক বৈদিক এবং বেদের মধ্যেও কথিত আছে।
শাক্ত ধর্মের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের মত দেখা যায় এখানে কোনো দেবতা নয় দেবীকে আরাধনা করা হয়। শিব আছেন তবে অন্য রূপে তিনি যেন দেবীর মহিমাকে আরও বেশি উজ্জলিত করে তুলেছেন।
শাক্ত মতে দেবী দুর্গা আর মা কালী দুই প্রধান আরাধ্য। তবে সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে মা কালীর শশ্মান রূপী মূর্তি শাক্ত উপাসকদের খুব প্রিয়। যা গৃহস্থের পক্ষে সহ্য করা খুবই কঠিন। শ্মশানচারী তন্ত্র সাধকদের মোক্ষ লাভের জন্য এই দেবী প্রিয়।
কথিত আছে, ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীশ্রীমা সারদা একবার দেবীর পুজো করেছিলেন। তবে ঠাকুর বলতেন, গৃহস্থ বাড়িতে পুজো তো দূরের কথা, এমনকি শ্মশানকালীর ছবি রাখাও অনুচিত। কারণ, উপযুক্ত তন্ত্রগুরু ব্যতীত এই কালীর উপাসনা অসম্ভবের নামান্তর এবং গৃহের জন্য বিপজ্জনকও বটে। এই দেবী সমস্ত দিক থেকেই ভীষনাকায়, রুদ্ররূপী
খড়্গধারী, সেইসঙ্গে শৃগালবাহন এই দেবী উলঙ্গিনী এবং মদ্যপানরতা। দেখতেও তিনি লোলজিহ্বা ভয়ঙ্করী। দ্রুত সিদ্ধিলাভ এবং কার্যসিদ্ধির নিমিত্ত যথাক্রমে বীরাচারী সাধক এবং ডাকাতরাই কেবল যুগ যুগ ধরে দেবী শ্মশানকালিকার অর্চনা করে এসেছে। নরবলি সহকারে। 'পঞ্চ ম-কার' অর্থাৎ 'মদ্য', 'মাংস', 'মৎস্য', 'মুদ্রা' এবং 'মৈথুন' শ্মশানকালীর পুজোয় অন্যতম প্রধান উপকরণ।
তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে এই দেবীর ধ্যানসম্মত মূর্তিটি হল: শ্মশানকালী দেবীর গায়ের রং কাজলের মতো কালো। তিনি সর্বদা শ্মশানে বাস করেন। তাঁর চোখদুটি রক্তপিঙ্গল বর্ণের। চুলগুলি আলুলায়িত, দেহটি শুকনো ও ভয়ংকর, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাস্যমুখে নরমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।
বঙ্গে যে আটটি রূপে কালীকে উপাসনা করা হয়, তার মধ্যে একমাত্র শ্মশানকালীকেই দেখা যায় মদ্যপানে। যদিও দেবী কালী মদ্যপান করেন কি না সেই নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।
বীরভূমের দুবরাজপুর এ শ্মশান কালী পুজো হয়। এই মন্দির প্রায় হাজার বছরের পুরনো। এই মাকে এক সাধক তপস্যা করে পান। তখন ভৈরব নামে এক পূজারী পুজো করতেন। মায়ের বেদী তৈরি ১০৮ টি নরমুণ্ড দিয়ে এবং সেই বেদীর উপরে মা পূজিত হন। বস্ত্রহীন হয়ে মাকে পুজো করতে হয় এবং পুজো করার সময় মায়ের মন্দিরের ভিতরে কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। মায়ের ঘট ভরতে যাওয়ার সময় সামনে শৃগাল যায়। এভাবেই সারা বাংলা জুড়ে বিভিন্ন রকম ভাবে শশ্মান কালীর পুজো হয়ে থাকে। প্রতিটি জায়গায় নানারকমের মিথ জড়িত রয়েছে। প্রতিটি মিথ কোনো বিশেষ শক্তির কথা রয়েছে। কোথায় মায়ের আরাধনার সময় শৃগাল এসে জড়ো হয়। কোথায় বা কাঁটার আসনে বসে কালী পুজো করতে হয়। এরকম নানা ধরনের নিয়ম আচার অনুষ্ঠান জড়িয়ে গেছে ভীষনাকার শ্মশানকালীর সঙ্গে। ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার গল্প তন্ত্র সাধনার অনুষঙ্গ রূপে।
নিবন্ধকারঃ রাহুল কর