ওলাইচন্ডী নাকি ওলা বিবি পুরাণে বর্ণিত কোনটি সত্য?

 পুরাণে দেবী চন্ডী আমাদের জনপ্রিয় দেবী দুর্গার সংহারিণী রূপ। যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেবতারা পরাজিত। সেই সময় দেবী পার্বতী কাত্যায়নি রূপ ধরে দেবতাদের বললেন কায়া দান করতে। দেবী চন্ড মূর্তি ধারণ করে অসুর নিধনে এগিয়ে যান। মহালয়ার ভোরে এই আখ্যান দেখে, এর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। তবে দেবী চন্ডী সর্বদা রণদা মূর্তিতে আমাদের কাছে ধরা দেন তা নয়। তিনি বাংলার লৌকিক দেবী হিসাবেও বিশেষ পরিচিত। এই দেবী চন্ডী প্রাচীন কালে বঙ্গদেশে বহু নামে ও রূপে পূজিত হতেন, যেমন: দেবীচন্ডী, মঙ্গলচন্ডী, জয়চন্ডী, ওলাইচন্ডী, কুলুইচন্ডী, চেলাইচন্ডী প্রভৃতি। জয়চন্ডীরূপে তিনি দ্বিভুজা, ত্রিনয়না, গৌরবর্ণা, বরাভয়হস্তা এবং পদ্মের উপর দন্ডায়মানা।

প্রাচীন বঙ্গদেশের লোকসমাজে চন্ডীকে বিভিন্ন রূপে কল্পনা ও বিশ্বাস করা হত, যেমন: শেওড়া গাছে অধিষ্ঠিত দেবীকে বলা হয় বনদুর্গা, পাকুড় গাছে অধিষ্ঠিত দেবী ষষ্ঠী, বসন্তরোগের উপশমকারিণী দেবী বসন্তচন্ডী বা বসন চন্ডী ইত্যাদি। কোনও কোনও গ্রামের নামের সঙ্গেও চন্ডীদেবীর সম্পর্ক রয়েছে, যেমন: বোয়াঁই চন্ডী, সগড়াই চন্ডী ইত্যাদি। কোথাও বিশেষ কোনো বৃক্ষে কল্পিত চন্ডীর কাছে মানতের লক্ষ্যে একখন্ড বস্ত্র বেঁধে দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। এখানে দেবী নেকড়াই চন্ডী নামে পরিচিত। আবার কোনও কোনও অঞ্চলে চন্ডী-অধিষ্ঠিত বৃক্ষের তলায় ঢিল বা ইটের টুকরো দিলেই তা পূজার সমতুল্য বলে গণ্য হয়। সেখানে দেবী ইটাল চন্ডী বা হেঁটাল চন্ডী নামে পরিচিত। ইনি হলেন একজন হিন্দু লৌকিক দেবী। ইনি ওলাদেবী, ওলাবিবি বা বিবিমা নামেও পরিচিত। ইনি কলেরার দেবী এবং অসুর পত্নী। পুরাণ মতে তিনি ময়দানবের স্ত্রী। যিনি কিনা স্বর্গ মর্ত্যে কারিগর হিসাবে প্রসিদ্ধ। পঞ্চপাণ্ডবের জন্য তৈরি করা ইন্দ্রপস্ত্র এই ময়দানবের তৈরি বলেই মহাভারতে বর্ণিত। একজন দক্ষ কারিগরের স্ত্রী হিসেবই ওলা বিবির পরিচিতি নয় তিনি বাংলার দেবী, বাংলায় এখনও তার পুজো প্রচলন আছে।

 বাংলায় তাঁর ছয় বোন বনবিবি,আজগাইবিবি, ঝোলাইবিবি ও আসানবিবির সঙ্গে তাঁর পুজো হয়। কোনও কোনও আধুনিক গবেষকের মতে 'সাতবিবি' নামে পরিচিত এই সাত দেবী আসলে হিন্দু সপ্তমাতৃকার (ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণী ও অন্যান্য) রূপান্তর। ভারতে সাত দেবীর পুজোযে সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে, তার প্রমাণ অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশের অন্তর্গত সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদাড়ো শহরের টেরাকোটা সিলমোহরে দেখা যায়। এই সিলমোহরে সাতজন নারীকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে ওই সাত দেবী যে সাত বিবি সে বিষয়ে কোনওরূপ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আবার ওলাই বিবি আর ওলাই চন্ডী একই বলে গবেষকরা দাবি করেন। সেক্ষেত্রে তিনি চন্ডীর আর এক রূপ নাকি সাত বিবির একজন সেই বিষয়ে সঠিক প্রমাণ কিছু পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। সেই বিশ্বাস থেকে ওলাওঠার দেবী ওলাবিবি বা ওলাইচন্ডী বাংলায় বিশেষভাবেই সমাদৃত। ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর পুজো প্রচলিত।

ওলাদেবী অসাম্প্রদায়িক দেবতা অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই দেবী পূজিতা। তবে দেবীর মূর্তি ও পূজাপদ্ধতিতে কিছুটা পার্থক্য আছে। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এঁর আকৃতি হয় লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো, গায়ের রঙ গাঢ় হলুদ বর্ণ, হাত দুটি প্রসারিত, কখনও দন্ডায়মান, কখনও বা শিশুসন্তান কোলে নিয়ে আসনে বসে আছেন, পরনে সাধারণত নীল শাড়ি এবং সর্বাঙ্গে নানা প্রকার অলঙ্কার। এঁর কোনও বাহন নেই।

মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে ওলাদেবীর আকৃতি ও পোষাকে ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। সেখানে এঁর মূর্তি অভিজাত ঘরের কোনও সুন্দরী কিশোরীর মতো, পরনে পিরান, পাজামা, টুপি, ওড়না এবং গায়ে নানা প্রকার অলঙ্কার। এ ছাড়া পায়ে থাকে নাগরা জুতা এবং কখনও কখনও মোজাও। এঁর এক হাতে থাকে আশাদন্ড যা দিয়ে ভক্তের মুশকিল আসান করেন।

তবে চন্ডী হোক বা বিবি, সাতবিবির মধ্যে ওলাদেবীই প্রধান; ভক্তরা তাঁর উদ্দেশ্যেই পুজো দেয়, তবে অন্যরাও সে পুজোর ভাগ পায়। ওলাদেবীর পুজো হয় গ্রামের গাছ তলায় বা পাতার কুটিরে। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে শনি অথবা মঙ্গলবারে পুজো হয় এবং পুজোয় নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। পুজোর পৌরোহিত্যে যে কোনও বর্ণ বা সম্প্রদায়ের লোকের, এমন কি নারীরও অধিকার আছে। মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে এঁকে ওলাবিবি বা বিবিমা নামে মানত করা হয়। হাড়ি বা ডোম-প্রধান অঞ্চলে তারাই পৌরোহিত্য করে এবং সেখানে তাদেরই অগ্রাধিকার থাকে।

ওলাদেবীর পুজো তিন রকম। শনিবার ও মঙ্গলবার অনাড়ম্বরে যে পুজোহয় তা বারের পুজো নামে পরিচিত। কারও মানত উপলক্ষে সামান্য আড়ম্বরের সঙ্গে যে কোনও সময় এই দেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া কোথাও কলেরা রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে সে এলাকার লোকজন গ্রামের মোড়লের নেতৃত্বে সমষ্টিগতভাবে এঁর পুজো দেয়।

ওলাদেবীর পুজোয় কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই। হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে একই পুরোহিতের হাতে পুজোর নৈবেদ্য ও মানতের দ্রব্য প্রদান করে। পুরোহিত নিম্নবর্ণের হিন্দু কিংবা মুসলমান হলেও কেউ তাঁর নিকট থেকে নৈবেদ্য গ্রহণে দ্বিধা করে না। ওলাদেবীর নৈবেদ্য অতি সাধারণ সন্দেশ, বাতাসা ও পান-সুপারি;  কোথাও কোথাও আতপ চাল ও পাটালিও দেওয়া হয়। এ পুজোয় বিশেষ কোনও মন্ত্র নেই; তবে কোনও কোনও হিন্দু পুরোহিত পুজোর সময় 'এসো মা ওলাদেবী, বেহুল রাঢ়ির ঝি' এরূপ আবেদন করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে একসময় খুব গুরুত্বের সঙ্গে ওলাদেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হত। 

তবে ওলা দেবী যে খুব বিখ্যাত তার প্রামাণ্য নজির হিসাবে হাওড়া শহরের একটি রাস্তার নামও ওলাইচণ্ডী লেন। এই রাস্তাতেই হাওড়ার বিখ্যাত হাজার-হাত কালীমন্দির অবস্থিত। কলকাতার উপকণ্ঠে গড়িয়া অঞ্চলের বৈষ্ণবঘাটায় ওলাবিবির একটি মন্দির রয়েছে। স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অধিবাসীরাই মন্দিরটি পরিচালনা করেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় জয়নগরের কাছে রক্তাখাঁ গ্রামে ওলাবিবির একটি মন্দিরে দেবী বিবিমা নামে পূজিতা হন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় রাজকোট দুর্গে অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে ওলাইচণ্ডীরও পুজোহয়। বীরভূমে বোলপুর নীলকুঠির পাশেও ওলাইচণ্ডীর একটি মন্দির রয়েছে

  কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে পরেশনাথ মন্দিরের উল্টোদিকে ওলাইচণ্ডীর একটি সুবৃহৎ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরে ষষ্ঠী, শীতলা ও মনসার সঙ্গে ওলাইচণ্ডীকেও পুজো করা হয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে তৎকালীন পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবী এই মন্দিরে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি স্থাপন করেছিলেন। তার আগে এখানে একটি পঞ্চানন মন্দির ছিল বলে জানা যায়। কথিত আছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির জনৈক কুঠিয়ালের স্ত্রী শ্রীমতী ডনকিং কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওলাইচণ্ডী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ডনকিং এক মুসলমান আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে সেই পঞ্চানন মন্দিরে এসে পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবীকে স্বপ্নের কথা জানালে ব্রহ্মময়ী দেবীই নিকটবর্তী একটি ঝিল থেকে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি মাথায় করে নিয়ে এসে মন্দিরে স্থাপন করেন। তখন থেকেই বিশেষ ভক্তি সহকারে দেবীর পুজো হয়ে থাকে।

বর্তমানে এই মন্দিরে একটি উঁচু বেদিতে মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী ও ওলাইচণ্ডীর পিতলের মূর্তি পূজিত হয়। মূর্তিগুলির উচ্চতা ২ ফুট। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় দুই বার শুকনো ভোগ নিবেদন করা হয়। চৈত্রমাসে শীতলা পুজোও অক্ষয়তৃতীয়া এই মন্দিরের দুই বাৎসরিক উৎসব। সেই সময় বহু ভক্তের সমাগম হয় মন্দিরে। এই উৎসবেই শুধুমাত্র অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। ওলাইচণ্ডীর পুজো হয় চণ্ডীর ধ্যান ও মন্ত্রে। বলিদানের প্রথা না থাকলেও মানতপূরণের বলি হয়ে থাকে। এমনকি মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরাও এখানে মানত বলি দিতে আসেন। সেই হিসাবে দেখতে গেলে এই দেবী সর্বোধর্ম সমন্বয়ের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...