কালী কথার গত পর্বে আমরা ব্রহ্মময়ী কালীর কথা জেনেছি। যে কালী রামপ্রসাদের গান শোনার জন্যে ঘুরে গিয়েছিল। আজকের কালী কথায় আমরা রামপ্রসাদের কালীর কথা জানব। কালী কীর্তনে তিনি মোহিত করেছিলেন বাংলার মানুষকে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও রামপ্রসাদী সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। রামপ্রসাদের লেখা শ্যামাসংগীত তিনিও গাইতেন। নিজেকে কালীর বেটা বলতেন সাধক কবি রামপ্রসাদ। তাঁর লেখা গান ছাড়া আজও কালীপুজো অসম্পূর্ণ। ব্রিটিশ ভারত, সময়টা সপ্তদশ শতক। ততদিনে চৈতন্যের ভক্তিবাদের ছোঁয়া পেয়ে গিয়েছে বাংলা। সেই সময়ে কালী ছিলেন এক শশ্মানবাসিনী দেবী। তান্ত্রিকেরা শ্মশানে এবং জনপদের বাইরে মা কালীর আরাধনা করতেন। শ্মশানবাসীনি নিরাভরণ তান্ত্রিকদের কালীই কালে কালে হয়ে উঠলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে। এই মেয়ে হয়ে ওঠা গতি দিয়েছিলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন। নিজের গানে, পদ বলাই শ্রেয়। পদে তিনি কালীকে কখনও মা বলে ডাকতেন, আবার কখনও মেয়ে বলে ডাকতেন। গানের মধ্যেই মিশে থাকত ভক্তিবাদ, সেখানে কালী কাল নন। তিনি স্নিগ্ধ। আবার মায়ের কাছে অভিযোগও জানান ভক্ত রামপ্রসাদ। আবার কালীকে খেয়ে নেওয়ার হুমকিও দেন রামপ্রসাদ। এবার কালী তোমায় খাবো! তান্ত্রিক-কাপালিকরা তন্ত্রসাধনার আড়ালে যে কালীকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। সেই কালীকেই মানুষের ঘরে নিয়ে এলেন তিনি। বেড়া ভেঙে গেল। কালীকে নিয়ে তাঁর গান মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো। আজও তা সমানভাবে জনপ্রিয়।
মনে করা হয়, ১৭২৩ সালে ২৪ পরগণার কুমারহট্টে অর্থাৎ আজকের হালিশহরে রামপ্রসাদের জন্ম। এক বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে রামপ্রসাদের জন্ম। পিতা রামরাম সেন ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে চিকিৎসক হোক। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই রামপ্রসাদকে আকর্ষণ করত আধ্যাত্মিক জগৎ। ছেলের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া রুখতে, বাইশ বছর বয়সে রামপ্রসাদের সঙ্গে বালিকা সর্বাণীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পারিবারিক প্রথা মেনে বিয়ের পর কুলগুরু মাধবাচার্যের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন রামপ্রসাদ ও সর্বাণী। সেদিন থেকেই রামপ্রসাদ মা কালীর পদতলে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। কালী পুজোর প্রবর্তক-তান্ত্রিক যোগী কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনা ও কালীপুজো পদ্ধতির শিক্ষা দিয়েছিলেন আগমবাগীশ। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সংসারে নেমে এসেছিল দারিদ্র্য। তাই বাধ্য হয়ে কালীসাধনা ত্যাগ করে দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তায় খাতা লেখার কাজ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই কাজ তাঁর জন্য নয়। কারণ মা কালী ছাড়া তাঁর মাথায় অন্য কোনও চিন্তা আসে না। সংসারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে তিনি সেরেস্তায় কাজ নিয়েছেন। সংসার চালাতে কেরানীর কাজ করতে হয়েছিল তাঁকে। কলকাতায় দুর্গাচরণ মিত্রের কাছারিতে হিসেবে রক্ষকের কাজ করতেন রামপ্রসাদ। কিন্তু হিসেবের খাতায় হিসেবের বদলে একের পর এক লিখতে লাগলেন শ্যামাসংগীত। সৃষ্টি হল দে মা আমায় তবিলদারি, আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী। সহকর্মীরা দুর্গাচরণের কাছে অভিযোগ জানালেন। কিন্তু সাধককে কি বেঁধে রাখা যায়! কেরানির কাজ থেকে রামপ্রসাদকে মুক্তি দিলেন! পাঠাতে শুরু করলেন ভাতা।
হালিশহরে ফিরে পঞ্চবটীর আসনে শুরু করলেন মায়ের আরাধনা। গ্রামে ফিরে রামপ্রসাদ বেছে নিয়েছিলেন সাধকের জীবন। সেখানে স্থাপন করেছিলেন পঞ্চবটী এবং পঞ্চমুণ্ডীর আসন। জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুবে গিয়েছিলেন নিগূঢ় কালীসাধনায়। প্রথম দশবছর বীরাচার, তারপর দিব্যাচারী সাধনায় নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। সারাদিন পড়ে থাকতেন পঞ্চমুণ্ডীর আসনে। কাছেই এক চালাঘরে মায়ের প্রতিমা নিজে তৈরি করে নিত্যপূজা করতে শুরু করেছিলেন। সারাদিন কাটত তাঁর মায়ের ধ্যান, পূজা, হোম, যজ্ঞ নিয়ে। মায়ের নাম জপ করতেন অষ্টপ্রহর। এরই ফাঁকে মাকে শোনাতেন স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত। আবেগ বিহ্বল রামপ্রসাদের চোখ থেকে তখন ঝরে পড়ত অশ্রুধারা। আপামর বাঙালির কাছে রামপ্রসাদ সেন হয়ে গিয়েছিলেন সাধক রামপ্রসাদ।কালীসাধনার পাশাপাশি রামপ্রসাদ অক্ষর দিয়ে বেঁধে রাখতেন মায়ের প্রতি তাঁর আবেগ ও অনুভূতিগুলোকে। তিনিই বাংলার প্রথম কবি, যিনি স্বরচিত শ্যামাসংগীতের মাধ্যমে তান্ত্রিকদের শ্মশানবাসিনী দেবী কালীকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। রামপ্রসাদ রচিত শ্যামাসংগীতে মা কালী ভয়ংকর ও উগ্ররূপিণী দেবী নন। কখনও তিনি মা, কখনও মেয়ে, কখনও স্ত্রী। একেরপর এক শ্যামাসংগীত লিখতে আরম্ভ করলেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে সভাকবি করতে চাইলেন। কিন্তু সে'সবে আগ্রহ ছিল না রামপ্রসাদের। সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন রামপ্রসাদ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সে সময় রামপ্রসাদকে ৫১ বিঘে নিস্কর জমি দান করেন। রামপ্রসাদ তাঁর 'বিদ্যাসুন্দর কাব্য' উৎসর্গ করেন নদীয়ার মহারাজকে। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৭৫৫-৫৬ সাল নাগাদ সিরাজউদ্দৌল্লার দরবারেও শ্যামাসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। নবাবও মুগ্ধ ছিলেন রামপ্রসাদের গানে। বিদ্যাসুন্দর কাব্যটি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মঙ্গলকাব্যের প্রবাদপ্রতিম কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে পড়তে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, কাব্যটি পড়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন ভারতচন্দ্র। তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে কবিরঞ্জন উপাধিতে ভূষিত করেন।
অন্যমতে, রামপ্রসাদের ভিটে, পঞ্চবটীর আসন রয়েছে হালিশহরে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের জমিদারি ছিল হালিশহরে। লোকমুখে রামপ্রসাদের কালীসাধনার কথা জানতে পেরে, সাবর্ণ জমিদাররাই ১৭৫৪ নাগাদ রামপ্রসাদকে কৃষিযোগ্য জমি ও বাস্তুভিটা দান করেন। এরাই রামপ্রসাদকে কবিরঞ্জন উপাধিতে ভূষিত করেন। এই ভিটেই স্থানীয় মানুষের কাছে, রামপ্রসাদের ভিটে নামে পরিচিত। কিংবদন্তি অনুসারে, এই ভিটেতেই বালিকার বেশে আদ্যাশক্তি মহামায়ার দর্শন পেয়েছিলেন রামপ্রসাদ। আজও সেখানে পুজো পান দেবী কালিকা।
এই ভিটেতেই নিজ হাতে মূর্তি গড়ে মায়ের পুজো করতেন সাধক কবি রামপ্রসাদ। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৭৮১সালে এক দীপান্বিতা অমাবস্যার পরের দিন মায়ের মূর্তি মাথায় নিয়ে নিজের লেখা শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে গঙ্গায় বিলীন হয়ে যান রামপ্রসাদ। গঙ্গায় বিলীন হবার পর তাঁর এই ভিটেও ভরে ওঠে জঙ্গলে। রামপ্রসাদী গান আজও সমান জনপ্রিয়। প্রায় দেড়শো বছর আগে, রামপ্রসাদের মৃত্যুর শতবর্ষে, হালিশহরের মানুষের উদ্যোগে রামপ্রসাদের ভিটে সংস্কার হয়। তারও ষাট-সত্তর বছর পর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় মায়ের মূর্তি। আজও সেই মন্দিরে হয় নিত্যপুজো।
রামপ্রসাদের জীবনের তিনটি ঘটনা কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। একদিন প্রসাদ বাড়ির সামনে বেড়া বাঁধছিলেন। তাঁর ছোট মেয়ে হাতে দড়ি ধরিয়ে দিচ্ছিল। একসময় বালিকা উঠে চলে যায়। কিন্তু প্রসাদ ঠিক হাতে দড়ি পেতে থাকেন। বেড়া বাঁধা চলতে থাকে। অনেক পরে মেয়ে ফিরে এসে বলে, বাবা কে দড়ি ধরিয়ে দিল? তখন প্রসাদের হুঁশ ফেরে। বোঝে এতক্ষণ মেয়ে কাছে ছিল না। বালিকা রূপে স্বয়ং মহামায়া এসেছিলেন। আরেক ঘটনা, একদিন প্রসাদ স্নানে যাচ্ছিলেন। তখন এক সুন্দরী অল্পবয়সি মেয়ে তাঁর গান শুনতে আসেন। প্রসাদ তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে স্নান সেরে ফিরে দেখেন সেই রমণী আর নেই। বদলে তাঁর চণ্ডীমণ্ডপের দেওয়ালে লেখা, আমি অন্নপূর্ণা, তোমার কাছে গান শুনতে এসেছিলাম। তাঁকে কাশীতে গিয়েও গান শুনিয়ে আসার অনুরোধ করা হয়। তবে কাশী বা বারাণসীতে যেতে হয়নি। তার আগেই স্বপ্নাদেশ পেয়ে ত্রিবেণীর কাছে জগজ্জননীকে গান শুনিয়ে আসেন তিনি।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মৃত্যুশয্যায় রামপ্রসাদকে দেখতে চেয়েছিলেন। মহারাজের সঙ্গে দেখা করে, তাঁকে গান শুনিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন রামপ্রসাদ। ত্রিবেণির খেয়াঘাটে তাঁকে ঘিরে ফেরেছিল কালীভক্ত রঘু ডাকাতের দলবল। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে নরবলির প্রয়োজন। তাই রামপ্রসাদকে স্নান করিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাড়িকাঠের সামনে, বলির জন্যে। রঘু ডাকাতকে রামপ্রসাদ বলেছিলেন মৃত্যুর আগে তিনি একবার মায়ের পুজো করে নিতে চান। নিষ্ঠাভরে কালীপুজো করেছিলেন রামপ্রসাদ। তারপর শ্যামাসংগীত গাইতে গাইতে রামপ্রসাদ হাড়িকাঠে গলিয়ে দিয়েছিলেন গলা। বলির খাঁড়া উঠে এসেছিল এক ডাকাতের হাতে। কোপ দেওয়ার আগের মুহূর্তে ডাকাত দল দেখেছিল, রামপ্রসাদের মুখের জায়গায় মা কালীর মুখ। হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল খাঁড়া। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলি। রামপ্রসাদের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল রঘু ডাকাত ও তার দলবল। পরদিন ভোরে নৌকায় রামপ্রসাদকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল রঘু ডাকাত। ঘটনাটি আমূল পরিবর্তন এনেছিল রঘু ডাকাতের জীবনে। ডাকাতি ও নরবলি ত্যাগ করে রঘু ডাকাত হয়ে উঠেছিল কালীসাধক।
প্রতি বছর কালী পুজো করতেন রামপ্রসাদ। প্রতিবারের মতো ১৭৮১ সালে মতান্তরে ১৭৭৫-এ দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালী আরাধনার আয়োজন করেছিলেন রামপ্রসাদ। বিপত্নীক রামপ্রসাদকে মাতৃ আরাধনায় সাহায্য করতেন পুত্র রামদুলাল ও পুত্রবধূ ভগবতী। সারারাত ধরে পুজো করার পর, ভোর রাত্রে মাকে গান শুনিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। পরদিন সন্ধ্যায় মায়ের ছোট্ট প্রতিমাটি মাথায় নিয়ে ভক্তবৃন্দের সঙ্গে চলেছিলেন গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার জন্য। প্রতিবছরের মতো সেবারও গেয়ে চলেছিলেন একের পর এক শ্যামাসংগীত। গঙ্গার বুকজলে নেমে মাকে আরও কয়েকটি গান শুনিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। তারপর মাকে মাথায় নিয়ে ডুব দিয়েছিলেন গঙ্গায়। আরও কয়েকটি ডুব দিলেন, গঙ্গাবক্ষ থেকে আর ফেরেননি তিনি। বলা হয়, বিদায়কালে মা তাঁর ছেলেকেও সঙ্গ নিয়ে গিয়েছিলেন। কালীর কোলে পতিতপাবনীতে বিলীন হলেন রামপ্রসাদ।