সুর ভুবনের ভুবনেশ্বরী তিনি। তাঁর গানে "প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়, রামধনু তার সাতটি রঙে দোল ঝরায়"... তাঁর সুরের মূর্ছনায় আকাশে তারা ঝিলমিল করে, স্বপ্নেরা মিছিল করে আসে। মুগ্ধ ভ্রমর (অলি) এসে চাঁপাকে ডাক দেয়। তাঁর কন্ঠের যাদুতে গোলাপ বাগানে মাধবী রাত নেমে আসে। চাঁদ ঘুমিয়ে পড়ে... নিবিড় রাতে পাতা শিরশির করে....শনশন শব্দে মেঘহাওয়া ডাক দিয়ে যায়.. অনুরাগে, প্রেমে কুহু সুরে কোকিল ডেকে ওঠে... তিনি... গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়... যার গানের "ইন্দ্রধনু"তে হৃদয় হারিয়ে যেতে চায়।
জন্ম ১৯৩১সালের ৪ঠা অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। বাবা নরেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। সঙ্গীত ব্যাপারটাই তাঁদের রক্তে ছিলো। তাঁর কথায় "আমাদের বংশের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় একজন নামী সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন"... তাঁর মা বাবা দুজনেই তাঁকে শৈশবে গান শেখাতেন। মা হেমপ্রভা দেবীও নিধুবাবুর টপ্পা খুব সুন্দর গাইতেন। বলছেন তিনি.."মা গাইতেন, আমি বসে শুনতাম। কত কারুকাজ ছিল তাঁর গানে। ভাবতাম, না শিখে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ কারুর গলায় আসে কেমন করে"..
সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় প্রথমে সন্তোষ কুমার বসু, পরে অধ্যাপক যামিনী গাঙ্গুলীর কাছে। কিছুদিন সঙ্গীতাচার্য চিন্ময়ী লাহিড়ীর কাছেও সংগীতের পাঠ নেন তিনি। এরপর তার ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা শুরু হয় ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁর কাছে। তাঁর কথায় "ওনাকে বাবা বলে ডাকতাম। প্রথম দিন আমার হাতে একটা মোটা লাল সুতো বেঁধে দিয়েছিলেন এবং মুখে একটু ছোলা এবং গুড় তুলে দিয়েছিলেন।".. যতদিন উস্তাদজী বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর সঙ্গে পিতা কন্যার সম্পর্ক ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের।
বারো বছর বয়সে আকাশবাণীতে "গল্প দাদুর আসর"-এ প্রথমবার গান করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন পাঁচ টাকা। তেরো বছর বয়সে তার প্রথম বেসিক রেকর্ড বের হয়। এক পিঠে গান "তুমি ফিরায়ে দিলে যারে" আর অন্য পিঠে "তোমারও আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো"..
ছোট্ট সন্ধ্যা তখন বারো বছরের বালিকা মাত্র। ১৯৪৩শে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেন। তাঁর কথায়..."বেপরোয়া গান গেয়ে কর্তব্য সমাপন করলাম। কাউকেই তখন চিনি না। পরে শুনলাম সেই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়"... যারা দুজনেই প্রবাদপ্রতিম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী। প্রথম স্থান অধিকার করলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৬ সালে "গীতশ্রী" পরীক্ষায় গীতশ্রী এবং ভজন দুই বিভাগেই প্রথম হলেন। এবং..."সেই যে আমার বিভিন্ন কম্পিটিশনে গাওয়া শুরু হলো তা একনাগাড়ে চলতেই থাকল। একাধারে খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি বাউল রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি, পুরাতনী সব ধরনের গান গাইতে লাগলাম। সব রকম না জানলে চলে না।"...কতটা একাগ্ৰতা ভাবা যায়!
একবার পয়লা জানুয়ারি রাজভবনে একটি অনুষ্ঠানে ভজন গাইলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ডেকে বললেন "এত মিষ্টি গলা তোমার। ভীষণ ভাল লেগেছে তোমার গান"...তাঁর কথায় "আমি তো লজ্জায় মরি আর কী"...
অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে সুচিত্রা সেনের লিপে প্রথমবার গান করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই অবিস্মরনীয় গান "গানে মোর ইন্দ্রধনু".. যে গান এখনোও এতো বছর পরেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সপ্তপদী ছায়াছবির গান "এই পথ যদি না শেষ হয়" নিয়ে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা এখানে জানানো যাক। সুচিত্রা সেন চেয়েছিলেন সপ্তপদী ছবিতে "এই পথ যদি না শেষ হয়" গানে তার লিপে যেন উৎপলা সেন গান করেন। কিন্তু গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একেবারে অন্ধ ভক্ত ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা এই ছবির গান যেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ানো হয়। তিনি উৎপলা সেনকে ফোন করে বললেন "দিদি আপনার মত বড় গায়িকা এই সামান্য গান কেন গাইবেন? এই গানে তো কয়েকবার 'তুমি বলো তুমি বলো' ছাড়া আর আপনার কিছুই করবার নেই"... উৎপলা সেন ওই গান থেকে সরে দাঁড়ালেন। গানটিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে উৎপলা সেনের জায়গায় গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাকিটা ইতিহাস.. তৈরি হয় সেই কিংবদন্তীপ্রতিম গান– বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে যে গানকে শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক গান বলে মনে করা হয়.. "এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো".. বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরদিনের আসন নিয়ে নিয়েছে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ষাট এবং সত্তরের দশকের সমস্ত বিখ্যাত নায়িকার লিপে গান গেয়েছিলেন। সুচিত্রা সেনের বেশিরভাগ ছবিতেই তাঁর গান। সুপ্রিয়া দেবী, অঞ্জনা ভৌমিক, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়.. কে নেই সেই নায়িকা তালিকায়! হিন্দি সিনেমাতেও তিনি দাপটের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন। কিন্তু মুম্বাই ছেড়ে ১৯৫২তে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় কলকাতায়। অভিন্নহৃদয় বন্ধু লতা মঙ্গেশকার। তাঁর জনপ্রিয় গানের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবেনা। তারমধ্যেও উল্লেখযোগ্য --এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়, তুঁহু মম মন প্রাণ হে, গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু, তীর বেধা পাখি আর গাইবে না গান, কি মিষ্টি এ সকাল... আরো অনেক...সোনা ঝরানো কন্ঠস্বর তাঁর....তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গানগুলি তো আজও মানুষকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। তাঁর গান আমাদের হাসায়, কাঁদায়, চূড়ান্ত ভালোলাগার অনুভূতি এনে দেয়।
এই ঊননব্বই বছর বয়সেও তিনি রেওয়াজ করেন, যোগাসন করেন এবং গান শোনেন।
জয়জয়ন্তী এবং নিশিপদ্ম চলচ্চিত্রে গানের জন্য দু'বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এই বাংলার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বঙ্গবিভূষণেও তিনি ভূষিত হয়েছেন। তাঁর কথায় "শ্রোতার ভালোবাসাই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার"..
একটুখানি ব্যক্তিগত কথা বলে এই নিবন্ধ শেষ করি?এই নিবন্ধকারের প্রিয়তম গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তো অবশ্যই এবং প্রিয়তম গান "মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা"... যে গান জীবনের সব দুঃখ ভুলিয়ে মনকে নিয়ে যায় এক অপূর্ব আনন্দজগতে যেখানে চির বসন্ত বিরাজ করে। সব শ্রোতাদেরও কি তাইই মনে হয় না?