আজ বলবো এমন অদ্ভুত নারীদের কথা গোটা বিশ্ব যাদের চেনে ‘জিরাফ নারী’ হিসেবে। মায়ানমারের শান প্রদেশের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বাস কায়ানদের। কিন্তু গোটা বিশ্বে তাদের পরিচিতি এই নামেই- কেন? সে কথাই জানাবো।
এই কায়ানরা নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতিতেই স্বচ্ছন্দ্য। তারা মায়ানমারে ‘পদাউং’ নামেও পরিচিত। স্থানীয় ভাষায় ‘পদাউং’ শব্দটির অর্থ লম্বা গলা। কায়ান উপজাতির নারীদের জন্য বিশ্বে তাদের এমন পরিচিতি । কায়ান নারীদের হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে তাঁদের মাথাটা হয়ত শরীর থেকে আলাদা। কতগুলো রিংয়ের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাথাটি। রিং’গুলি কিন্তু কায়ান নারীদের অলঙ্কার। কিন্তু স্বাভাবিক গঠনের শিশু কন্যাকে কীভাবে বানানো হয় জিরাফ নারী!
মেয়েদের বয়স পাঁচ বছর হলেই কায়ানরা শিশু কন্যাগুলির গলায় পরিয়ে দেয় ১কেজি ওজনের ধাতব বেড়ী। এগুলি কোনও পৃথক রিং নয়। এটি একটি স্প্রিং-এর মতো ধাতব কুণ্ডলী। পিতলের সঙ্গে সামান্য সোনা মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই বেড়ী। বয়স বৃদ্ধির সাথে ভার সহ্য করার ক্ষমতা থাকলে বেড়ীর ওজন বাড়ানো হয়।
কায়ান নারীরা যখন যুবতী হন তখন দেহের তুলনায় অস্বাভাবিক লম্বা লাগে গলা। ঠিক জিরাফের মতো। বেড়ী পরা অবস্থায় কায়ান নারীদের গলা ১ফুট বা তার চেয়েও বেশি লম্বা হয়। শুনতে অবাক লাগলেও গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা গলার দৈর্ঘ্য ১৫.৭৫ইঞ্চি এবং সেই গলাটি একজন কায়ান নারীর।
যে নারী যত বেশি ওজনের বেড়ী গলায় পরেন, কায়ান সমাজ তাঁকে তত বেশি মর্যাদা দেয়। ফলে যন্ত্রণার বিনিময়ে সম্মান কিনতে রাজি হন অনেক কায়ান নারী। কায়ানদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি তাঁদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদা এবং বিত্ত-বৈভবের পরিচয়ও বহন করে থাকে এই ধাতব বেড়ীগুলি।
কিন্তু সত্যি কি এই বেড়ীর কারণে তাদের গলা লম্বা হয় ? গবেষকদের মতে, এই ভারী ধাতব বেড়ি কায়ান মহিলাদের গলাকে দৈর্ঘ্যে লম্বা করে না। কায়ান শিশুকন্যাদের গলায় চাপানো ওজন ধীরে ধীরে তাদের দুই কাঁধের ক্ল্যাভিকল (clavicle) হাড়কে অস্বাভাবিক ঢালু করে দিতে থাকে। যার ফলে কাঁধ থেকে গলাটি অনেকটা উপরে উঠে যায়। ফলে কায়ান নারীদের গলা লম্বা বলে মনে হয়।
সমাজ এই বেড়ীগুলিকে অলঙ্কার ভাবলেও, শারীরিক দিক থেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন জিরাফ নারীরা। বাল্যকাল থেকে ভারী বেড়ী পরে থাকার জন্য কায়ান নারীদের গলার চামড়া বিবর্ণ হয়ে যায়, গলা ও ঘাড়ের পেশীগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে, স্পাইনালকর্ড রীতিমত ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
কায়ান সমাজে আবার কথিত আছে যে, কয়েক হাজার বছর আগে, মাঝেমাঝেই গ্রামগুলিতে হামলা চালাত বাঘের দল। নারীদের ঘাড় কামড়ে তুলে নিয়ে যেত। বাঘেদের প্রথম লক্ষ্য থাকে মানুষের ঘাড় কামড়ে ধরা। তাই কায়ান নারীদের ঘাড়কে সুরক্ষিত করতে নারীদের গলায় বেড়ী পরাবার রীতি শুরু হয়েছিল। ফলে বাঘের আক্রমণে কায়ান নারীদের মৃত্যুর হার কমে গিয়েছিল। কিন্তু শিশুপুত্রদের পরানো হয়নি কেন! যাইহোক, এ নিয়ে বিস্তর মত ও বিতর্কের অবতারণা হয়েছে।
কায়ান নারীদের অনেকেই আজ কায়ান সমাজের এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন। চলছে প্রথা ভাঙার লড়াই।