ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি,
ঘেঁটুকে দাও গো পয়সা কড়ি।
কয়েক দশক আগেও ফাল্গুনের শেষ দিনে পাড়ায় পাড়ায় শোনা যেত এই ডাক। সন্ধে নামলেই শাড়ি আর চন্দনে সেজে বাড়ি বাড়ি চাল-ডাল-পয়সা আদায় করতে বেরত ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা। শুধু গ্রাম নয়, হাওড়া-হুগলীর শহরতলীতেও এই দৃশ্য দুর্লভ ছিল না। কিন্তু এখন গ্রামেও বোধহয় এই ছবি আর মেলে না।
দোলের পরব শেষ হলেই জঙ্গলের ধারে ধারে সাদা রঙের এক ফল। ভিতরটা মেরুন। এই ফুলের নামেই পরব। জীবনানন্দের কবিতায় যে ফুলের পরিচিতি ভাটফুল নামে, গ্রাম বাংলায় সেই ফুল-ই লোকমুখে ‘ঘেঁটু ফুল’।
শোন শোন সর্বজন ঘাঁটুর জন্ম বিবরণ।
পিশাচ কুলে জন্মিলেন শাস্ত্রে লিখন।
বিষ্ণুনাম কোনমতে করবে না শ্রবণ
তাই দুই কানে দুই ঘন্টা করেছে বন্ধন।
ফাল্গুণ মাসের সংক্রান্তিতে ঘেঁটুপুজো হয়ে থাকে। ‘ঘন্টাকর্ণ’র আটপৌরে নাম ঘেঁটু ঠাকুর। সূর্য ও ধর্মঠাকুরের লৌকিক রূপ। প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী ঘন্টাকর্ণ আদতে শিবের অনুচর। তার জন্ম পিশাচ কুলে। চর্মরোগ থেকে বাঁচতে ঘন্টাকর্ণ পুজো করে গ্রামের মানুষ। ‘ খোস-পাঁজড়া’ হয় না। পুজো হয় সকাল বেলায়। প্রধান উপাচার ‘ঘেঁটু ফুল’।
কাহিনি অনুসারে, ঘেঁটু হলেন এক জন অভিশপ্ত দেবতা। তিনি ভগবান বিষ্ণুর রোষানলে পড়েন এবং দেবলোক থেকে নির্বাসিত হন। অভিশাপের কারণেই হয়ে ওঠেন ঘোরতর বিষ্ণুবিদ্বেষী ।
বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত যাতে শুনতে না হয়, সে জন্য তিনি কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। সেই থেকেই ঘেঁটুর অপর নাম হয় ‘ঘণ্টাকর্ণ’।
জৈন ধর্মেও ঘন্টাকর্ণ দেব বা ঘেঁটু ঠাকুরের উল্লেখ আছে।
জৈন মতে ইনি ৫২ বীরের অন্যতম। এক সময় ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধিপত্য বাড়লে কৌলিন্য হারান।
ঘেঁটু ঠাকুরের নামের মতো তাঁর মূর্তিটিও ভারী অদ্ভুত। আধভাঙা ব্যবহৃত মাটির হাড়ি উল্টো করে রাখা হয়। এটিই এই গ্রামীণ লৌকিক দেবতার আসন। হাঁড়ির ওপরে একদলা গোবর দিয়ে গড়া হয় ঘেঁটু দেবতার মুখ। চোখ তৈরি করা হয় দুটি কড়ি দিয়ে। ঘেঁটু দেবের কপালে আঁকা হয় সিঁদুরের তিলক।
কলার পাতা দিয়ে পালকি তৈরী করে পালকির ভিতরে প্রদীপ জালিয়ে এবং পালকিটিকে ঘেঁটু ফুল দিয়ে সাজিয়ে ঘেঁটু ঠাকুরের পুজো করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা। কলা পাতার বদলে অনেকে কাগজ দিয়েও পালকি বানান।
ঘেঁটু পুজোতে কোনও পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। মহিলারা পুজো করেন। ভোরবেলা গৃহস্থের বাড়ির বাইরে রাস্তার মোড়ে পুজো করা হয়। পুজোর শেষে লাঠি দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় ঘেঁটুর আসন। হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান এবং রাঢ় বঙ্গের অন্যান্য জেলার গ্রামেগুলোতে এই লৌকিক আচারের চল আছে।
যে দেবে মুঠো মুঠো, তার হবে হাত ঠুঁটো,
যে দেবে থালা থালা, তার হবে সোনার বালা।
যে দেবে বাটি বাটি, তার হবে সাত বেটি,
যে দেবে কাপ কাপ, তার হবে সাত বাপ।
যে দেবে ঘড়া ঘড়া, তার ঘরে ………
যে দেবে মড়াই মড়াই, তার ঘরে সোনা ছড়াই।
সকালে পুজো হয়ে গেলে ছোট-ছোট ছেলে মেয়েরা সন্ধেবেলা প্রদীপ হাতে ঘেঁটুগান গেয়ে গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি মাধুকরী করে। সেই দিয়ে ‘বনভোজন’ এর প্রথা চালু ছিল।অনেকটা এই প্রজন্মের ‘হ্যালোইন’ এর মতো। মানুষের বিশ্বাস ঘেঁটুর আসনের গোময় বাড়ির দরজায় রাখলে অসুখ প্রবেশ করতে পারে না। ঘেঁটু পুজো চলত গোটা চৈত্র মাস ধরে।