মনে করুন গরম কালের একটা ছুটির দিনের সন্ধ্যাবেলা। অথবা শেষ ডিসেম্বরের নরম রোদ ভরা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা একটা দুপুর। ঘরে কিছুতেই আর মন থাকতে চাইছে না। নিজের প্রিয় মানুষটির সঙ্গে অথবা একাই যেতে ইচ্ছে করছে এমন কোনো জায়গায় যেখানে গেলে এই ব্যস্ত শহরের মধ্যেই আপনি পাবেন অনেক গাছ, বাগান, অপরূপ স্থাপত্য, গঙ্গার বুকে সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ, নৌকায় বেড়ানোর ব্যবস্থা, পাশাপাশি সন্ধ্যায় চমৎকার আলোকসজ্জা, বিভিন্ন লোভনীয় খাবারের স্টল। তখন তো আপনি বেরিয়ে পড়বেনই আর কলকাতার মধ্যেই এরকম একটা জায়গায় বেড়াতে যেতে চাইলে যে জায়গাটার নাম আপনার মনে পড়বেই...সেটা হলো প্রিন্সেপ ঘাট...১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত হুগলি নদীর এই ঘাট কলকাতাবাসীদের এবং পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। শুধু দ্রষ্টব্য স্থানই নয়, প্রিন্সেপ ঘাটের ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। আসুন, এর ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করি।
তখন জলপথেই যাতায়াত চলত ইংল্যান্ড এবং ভারতের মধ্যে। কলকাতারই চাঁদপাল ঘাটে এসে দাঁড়াতো সব বিদেশি জাহাজ। এমনই এক জাহাজে চড়ে এসে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার মাটিতে পা রাখলেন এক কুড়ি বছরের যুবক - নাম জেমস প্রিন্সেপ। তিনি কলকাতার টাঁকশালে বা মিন্টে সহকারী ধাতু পরীক্ষক (Assey Master) হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁর এই শহরে আসা। এই পদে তিনি মাত্র এক বছর কলকাতায় ছিলেন। তারপর তিনি নতুন টাঁকশাল খোলার জন্য কাশীতে চলে যান। কাশীতে টাঁকশাল, একটা গির্জা ও একটা সেতু তাঁরই হাতে তৈরী হয়। অসাধারণ একজন চিত্রশিল্পীও ছিলেন তিনি। ১৮২২ সালে তাঁর নেতৃত্বে কাশীর উপর একটা সার্ভে করা হয়েছিল। সেই সময় তিনি এই সার্ভে রিপোর্টের সাথে কাশী শহরের একটি ম্যাপ এঁকে দিয়েছিলেন। এই চমৎকার মানচিত্রটি প্রাচীন কাশীর একটা দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯২৯-এ তিনি ডেপুটি অ্যাসে মাস্টার (Deputy Assey Master) হিসেবে আবার কলকাতার টাঁকশালে ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে এখানকার
টাঁকশালেই তিনি অ্যাসে মাস্টার (Assey Master) হন। তিনি "Gleanings of Science" নামে একটা সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এই সাময়িক পত্রিকাটিই পরবর্তীকালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩২ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তাঁর জীবনের সর্বশেষ্ঠ কাজ হলো পাহাড়ের গায়ে ও পাথরের স্তম্ভে খোদিত সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোকের লিপিগুলোর পাঠোদ্ধার করা। যার থেকে আমরা, ভারতবাসীরা প্রথম জানতে পেরেছি মহামতি অশোকের সময়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস।
কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে তাঁর শরীর এত অসুস্থ হয়ে পড়ে যে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। জেমস প্রিন্সেপ মাত্র ৪১ বছর বয়সে ২২শে এপ্রিল ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে মারা যান।
এই অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটির স্মৃতিতে ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতারই মানুষদের দানে বারো হাজার টাকা ব্যায়ে নির্মিত হয় গঙ্গার ধারে একটি স্মৃতিসৌধ এবং একটি ঘাট। এই অপরূপ সুন্দর বিরাট সৌধটির নকশা করেন ডব্লিউ ফিজগেরাল্ড। এর গায়ে জেমস প্রিন্সেপের নাম খোদাই করা রয়েছে। এই ঘাট থেকে সেইসময় নৌকা ও জাহাজ চলাচলও শুরু হয়েছিলো। এখনো এই ঘাটে নৌকা করে গঙ্গায় বেড়ানোর বন্দোবস্ত রয়েছে।
তাহলে আর দেরি কেন? চলুন এই শরতের এক আকাশ নীল গায়ে মেখে দেখে আসি প্রিন্সেপ ঘাট আর তার সঙ্গে মনে মনে শ্রদ্ধা জানাই সেই অপ্রতিম মানুষটিকে যার কারণে আমরা আমাদের দেশের গৌরবময় এক অতীত অধ্যায়ের কথা জানতে পেরেছিলাম।