ঘুরতে ঘুরতে আমরা কতগুলো ঘাট খুলে ফেললাম তাইনা? আটখানা ঘাট কিন্তু আমাদের ঘোরা হয়ে গেছে। আজকে আমরা চলে এসেছি ন'নম্বর ঘাটে যে ঘাটের নাম মতি শীলের ঘাট। হুগলি নদীর তীর ধরে অনেক অনেক ঘাট আছে কিন্তু আমি এই সিরিজ লিখছি বিশেষ কিছু ঘাটের উপরে যেগুলোর সঙ্গে কলকাতা শহরের ইতিহাসের যোগ তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের ইতিহাসও। ঘাটের কি আর ঘাটতি আছে আমাদের নদীমাতৃক দেশে?
মতি শীলের সঙ্গে মতিঝিলের মিল আছে তাই না? ঠিকই ধরেছেন ওই একই মানুষের নামে এই ঘাট এবং ওই ঝিল দুটোই। এই মতি শীল বা মতিলাল শীল হল আজকে আমাদের লেখার বিষয়বস্তু...তবে, ঠিক বস্তু কি বলা যায়? বিষয়-ব্যক্তি বললেই বা অসুবিধা কোথায়? তিনি সত্যিই এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অথবা রামমোহন রায়ের মতো মহামানবের। আবার বিষয় সম্পত্তির দিক থেকে বলতে গেলেও প্রায় কপর্দকহীন অবস্থা থেকে একজীবনেই অসম্ভব বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন এই মতিলাল শীল। সম্পত্তির বহর দেখলে মনে হবে আধখানা কলকাতাটাই ছিল মতিলাল শীলের।
১৭৯২ খ্রীস্টাব্দে কলকাতায় মতিলাল শীল এর জন্ম হয়। বাবা চৈতন্য চরণ শীল ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃহীন হয় মতিলাল। এক আত্মীয়ের সংসারের আশ্রয় পেলেও লেখাপড়া খুব বেশি দূর পর্যন্ত করতে পারেননি। অল্প বয়সেই চাকরি এবং ব্যবসা দুটোই শুরু করেন তিনি। আমরা বইয়ে পড়েছি বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী। কিন্তু বাণিজ্যের সেরকম কোন উদ্যোগ আমরা বিশেষ নিই না। বাণিজ্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পেশা। সেখানে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন বুদ্ধি, সততা, সাহস, ধৈর্য, পরিশ্রম এবং দূরদৃষ্টি। সকলের সেটা থাকে না কিন্তু মতিলালের ছিল। তিনি অতি সামান্য অবস্থায় ব্যবসা শুরু করে সেই সময়ে কোটিপতি হয়েছিলেন। সামান্য শিশি-বোতল এর ব্যবসা দিয়ে তার বাণিজ্য শুরু করে তিনি দেশের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পপতি হয়ে উঠেছিলেন। জাহাজের ব্যবসা ছিল তাঁর। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যে অর্থাৎ দেশের মধ্যে জাহাজের কারবারে তিনিই প্রথম বাষ্পীয় পোত ব্যবহার করেছিলেন। সেই সময় তাঁকে ধনকুবের বলা হতো। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে একসাথে তাঁর নামও উচ্চারিত হতো শিল্পপতি হিসেবে।
এবার তাঁর সমাজ সংস্কার এবং দান ধ্যানের কথা একটু বলা যাক। বিদ্যাসাগরের বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সতীদাহ প্রথা রোধ এর জন্য রামমোহন রায় যে আন্দোলন করেছিলেন সেই আন্দোলনে মতিলাল শীল সবসময় তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই বাংলায় প্রথম বিধবা বিবাহকারীকে তিনি কুড়ি হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন।
দানের এবং সেবামূলক কাজের সীমা-পরিসীমা ছিল না তাঁর। কলকাতা মেডিকেল কলেজ খোলার জন্য তিনি জমি এবং এককালীন ১২,০০০ টাকা দান করেন। যেই সময়ে বিলাসিতার পিছনে কলকাতার ধ্বনি মানুষরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতেন সেই সময় তিনি সমাজ সংস্কারে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। দুস্থ ছাত্রদের ডাক্তারি পড়ার জন্য তিনি এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি যেমন কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছিলেন তেমন গরীব-দুঃখীকে অকাতরে দানও করতেন। তৈরি করেছিলেন "শীলস ফ্রী কলেজ", যেখানে ছাত্ররা সম্পূর্ণ নিখরচায় থাকা-খাওয়া এবং পড়াশুনার সুযোগ পেত। বেলঘরিয়ায় ও বেহালায় দুটি অতিথিশালা তৈরি করেছিলেন যেখানে দিনে কয়েক হাজার মানুষ কোন পয়সা ছাড়া খাওয়ার সুযোগ পেতেন। এছাড়া গঙ্গার ঘাট তো আছেই।
এবার মতি শীলের ঘাট সম্পর্কে একটু বলে নিই। আর্মেনিয়ান ঘাটের ঠিক দক্ষিনে মতি শীলের ঘাট। এই ঘাট গঙ্গা-স্নানার্থীদের জন্য ১৮৪৬ সালে বানিয়ে দিয়েছিলেন মতিলাল শীল। সেইসময় কলকাতার উত্তরভাগে গঙ্গার পুরনো স্নানের ঘাটগুলির অবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই, পুণ্যার্থীদের স্নানের সুবিধার জন্য একটি নতুন ঘাট তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবু মতিলাল শীল। এই ঘাটের অবস্থান নাকি আরো উত্তর দিকে ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই ঘাটকে আর্মেনিয়ান ঘাটের পাশে নিয়ে আসে। মতিলাল শীলের পুত্র হীরালাল শীল এই ঘাট স্থানান্তরিত করার কারণে অনেক দিন ইংরেজ সরকারের সঙ্গে মামলা চালিয়ে পোর্ট কমিশন থেকে মোটা খেসারত আদায় করেছিলেন। মতিলাল শীল ঘাট চারটি কারুকার্যময় থামের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ঘাটের পাশে একটা মন্দির আছে। সন্ধ্যাবেলা সেখানকার ঘণ্টাধ্বনি শুনলে মন আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। এই ঘাটেই ১৮৫৪ সালের ২০শে মে দানবীর মতিলাল শীলের মৃত্যু হয়।
তথ্য ঋণ: কলিকাতা দর্পণ-রাধারমণ মিত্র