আজ ঘাটে ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে এবার পৌঁছে গিয়েছি আরেক ঐতিহাসিক ঘাটে - "মায়ের ঘাট"। নামেই বোঝা যাচ্ছে যে এই ঘাটের সঙ্গে আমাদের মা জড়িয়ে আছেন। ইনি আমাদের সকলের মা... "আমি সৎ-এরও মা অসৎ-এরও মা, আমজাদেরও (কুখ্যাত ডাকাত) মা, শরতেরও (ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের সাক্ষাৎ শিষ্য স্বামী সারদানন্দ) মা"। পাতানো মা নয় আমাদের সত্যিকারের জননী - মা সারদা - শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের ধর্মপত্নী। আসুন, আজ শ্রী শ্রী মায়ের পদধূলি-ধন্য এই ঘাটটির কথা একটু জেনে নিই।
রাজা রাজবল্লভের ঘাট যাকে আমরা বাগবাজার ঘাট বলে জানি তার পাশেই আছে মায়ের ঘাট। আগে এই ঘাটের নাম ছিল "বিচালি ঘাট"
১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রয়াণের পর সারদা মা আর দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যান নি। কিন্তু কলকাতায় তাঁর বসবাসের নির্দিষ্ট কোনো বাড়ি ছিলো না। সেই সময় তিনি কামারপুকুরে কিছুদিন বাস করছিলেন। এই সময় তাঁকে নিদারুণ অর্থাভাবে পড়তে হয়। এই খবর রামকৃষ্ণ দেবের শিষ্যদের কানে পৌঁছালে তাঁরা মা'কে কলকাতায় নিয়ে আসেন। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে তাঁর গুরুভাইদের অনুরোধ করে চিঠি পাঠান যেন তাঁরা মা'কে ঠিকমতো দেখাশোনা করেন। কিন্তু কলকাতায় কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান না থাকায় তখনও তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণের বিভিন্ন শিষ্যদের বাড়িতেই আতিথ্য গ্ৰহণ করতেন। অবশেষে বাগবাজারে গঙ্গার কাছেই স্বামী সারদানন্দ এবং ঠাকুরের অন্যান্য শিষ্যরা নতুন দোতলা বাড়ি তৈরি করলেন যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের মাসিক মুখপত্র "উদ্বোধন" পত্রিকার নতুন অফিস হলো এবং ১৯০৯ সালে মা'কে সেখানে পাকাপাকি ভাবে নিয়ে আসা হলো। এই বাড়িতেই দোতলার একটি ঘরে মা সারদা মৃত্যু পর্যন্ত বাস করেন। এখনোও এই বাড়ি "মায়ের বাড়ি" নামেই বিখ্যাত।
বাগবাজারের বাড়ি থেকে মা যতদিন জীবিত ছিলেন (১৯২০ পর্যন্ত) ততদিন নিয়মিত গঙ্গাস্নানে যেতেন। তাঁর ঘরের জানালা দিয়েও গঙ্গা দেখা যেত। তিনি যে ঘাটে স্নান করতে যেতেন হুগলি নদীর সেই ঘাট আগে "পাগলা বাবুর ঘাট" বা বিচালি ঘাট নামে পরিচিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে "মায়ের ঘাট" নামেই পরিচিতি লাভ করে।
এই ঘাট দেখতে, স্নান করতে মায়ের এবং শ্রী শ্রী ঠাকুরের ভক্তরা ছাড়াও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। বিশেষ করে ঠাকুরের জন্মতিথি এবং মায়ের জন্মতিথিতে সারা দেশ থেকে এমন কি বিদেশী বহু পর্যটকদেরও ভিড় হয়। ঘাটের পাশেই একটি ঘরে সারদা মায়ের একটি প্রতিকৃতি রয়েছে। ভক্তরা স্নানের পর সেখানে ফুল ফল মিষ্টি ধূপ সহকারে মা'র পুজো করেন। সাম্প্রতিক কালে এই ঘাটে সন্ধ্যাবেলায় গঙ্গারতিরও আয়োজন করা হয়। শ্রী শ্রী মা এবং ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই ঘাট শুধু একটি ঘাটই নয়, মানুষের কাছে এর মাহাত্ম্যও কম নয়। মায়ের ঘাটকে কলকাতা একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবেই গণ্য করা হয়।