কলকাতা শহরটা বড় সুন্দর একটা শহর। নিজের শহর বলে বলছি না বা রাজধানী শহর বলেও নয়, কলকাতার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, পুরনো ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের সঙ্গে আধুনিকতা হাত ধরাধরি করে চলে এখানে। হুগলি গঙ্গার তীরের এই শহরটির শরীরে মিশে আছে কত ইতিহাস। বয়স ও তো কম হল না তার। আর সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতার গঙ্গার ঘাটগুলি। আজ ঘাটের কথার দশম পর্বে চলে এসেছি। এবারের পর্বে লিখবো "কাশীপুর প্রামাণিক ঘাটের" কাহিনী।
কাশীপুর – এই নামটা মনে পড়ে? না পাঠক, আমি কোনো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এখানে কলম খুলে বসিনি। তবে হ্যাঁ, কাশিপুর নামের সঙ্গে কলকাতার বা পশ্চিমবঙ্গের একটা বিশেষ সময় বা আন্দোলন জড়িয়ে আছে। এছাড়া দেশের মধ্যে প্রথম "Ordinance Factory" স্থাপিত হয় এই কাশীপুরেই। সালটা ১৮০১-১৮০২।
কিন্তু তা ছাড়াও কাশিপুর নামটার সঙ্গে একজন মহামানবের নাম ও জড়িয়ে আছে। তিনি হলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। এই কাশিপুরের উদ্যানবাটিতেই তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন। আর আজ যে কাশীপুর প্রামাণিক ঘাট নিয়ে এই নিবন্ধ সেই ঘাটের সঙ্গে ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাঁর নাম।
কাশীপুর প্রামাণিক ঘাট নির্মাণ করেছিলেন দুর্গাপ্রসাদ দে প্রামাণিক এবং রামগোপাল দে প্রামাণিক। এদের বংশের আদিপুরুষরা আগে থাকতেন বর্ধমান জেলার সেলিম পুর গ্রামে বসবাস করতেন। তাঁদেরই একজন শ্রী কৃষ্ণদাস দে বঙ্গাব্দ দ্বাদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ইংরেজি ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে
ব্যবসা উপলক্ষে কলকাতা উত্তরের বরানগরে এসে বসবাস করতে থাকেন এবং প্রামাণিক উপাধি লাভ করেন। এই কৃষ্ণদাস দে প্রামাণিকের অধস্তন পঞ্চদশ পুরুষ শ্রী দুর্গা প্রসাদ দে'র তত্ত্বাবধানে এবং রামগোপাল দে'র বিশেষ উদ্যোগে গঙ্গার তীরে প্রামাণিক ঘাট নির্মিত হয় এবং এই দুর্গাপ্রসাদ দে প্রামাণিক দ্বারাই ঐ ঘাটের কাছেই দক্ষিণা কালিকা মা ব্রহ্মময়ীর প্রস্তরমূর্তি এবং মহাদেব প্রতিষ্ঠিত হন।
এবার আসি এই মূর্তির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে দু চার কথায়। এই মা ব্রহ্মময়ীকে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব "মাসি" সম্বোধন করতেন। কি সুন্দর ডাক, তাই না? এর পিছনে একটা সুন্দর ঘটনাও আছে। পাঠকবন্ধুরা কি জানেন দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণীর মায়েরা তিন বোন। মা ভবতারিণী হলেন মেজোবোন, তাঁর দিদি হলেন মা নিস্তারিনী...তিনি প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন কলকাতারই গোয়াবাগানে এবং ছোট বোন হলেন এই মা ব্রহ্মময়ী কালী যিনি প্রতিষ্ঠিতা রয়েছেন প্রামানিক ঘাটের কালিমন্দিরে। আসলে এই তিনটি বিগ্ৰহই একটি বড় কষ্টিপাথরের থেকে তৈরি করেছিলেন নবীন পাল নামে এক ভাস্কর। এবং সেই সূত্রেই এই দেবী মায়েরা তিন বোন। যেহেতু শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব মা ভবতারিণী কে "মা" সম্বোধন করতেন তাই এই ব্রহ্মময়ী মা কালী'কে মাসী বলে ডাকতেন এবং প্রায়ই "মাসির বাড়ি চললাম" বলে দক্ষিণেশ্বর থেকে চলে আসতেন কাশীপুর প্রামাণিক ঘাটের এই মায়ের মন্দিরে।
কখনো, কোনো এক বিকেলে এই ঘাটে বসে যদি কল্পনা করা যায় যে স্বয়ং ঠাকুর রামকৃষ্ণ এসে তাঁর মাসির সঙ্গে তাঁর "মা"য়ের কথা বলছেন, হাসছেন , গল্প করছেন, প্রসাদ নিচ্ছেন....
আমাদের মনে হবেই...
"এই মানবজমিন রইলো পতিত
আবাদ করলে ফলতো সোনা"...
তথ্য ঋণ: কলিকাতা দর্পণ..রাধারমণ মিত্র