তিনি একজন তরুণ সন্ন্যাসী। সারা বিশ্ব জয় করে ফিরেছেন তিনি। ধীর অথচ দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন গঙ্গার ঘাটের দিকে। শরৎ সকালের রোদের সঙ্গে যেন তাঁর শরীরের সত্যের, ত্যাগের, ন্যায়ের তেজ ও দীপ্তি মিশে যাচ্ছে। তাঁর পিছনে আসছেন অন্যান্য তরুণ ব্রহ্মচারীরা এবং ঢাকির দল। সেই সূর্যসম উজ্জ্বল সন্ন্যাসী দুই হাতে ধরে রেখেছেন দুর্গাপূজার নবপত্রিকা। তিনি নামলেন গঙ্গায়। নিজে ডুব দিয়ে স্নান করলেন, স্নান করালেন নবপত্রিকাকে। বেজে উঠল ঢাক। চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল শঙ্খধ্বনিতে।
সেদিনের সেই তরুণ সন্ন্যাসী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ আর যে ঘাটে তিনি নবপত্রিকা স্নান করাতেন সেই ঘাট হল বেলুড় মঠের গঙ্গার ঘাট। আজও বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার নবপত্রিকা সেই ঘাটেই স্নান করানো হয় এবং প্রতিমা বিসর্জন ও হয় বেলুড় গঙ্গার ঘাটে।
ঘাটের কথা বলতে বলতে এবার এসে গেছি এবারের মতো শেষ ঘাটে। শেষ পারানির তরী বাইতে... আরে না না, এই সিরিজের শেষ পর্বে। এবার বলব বেলুড় মঠ সংলগ্ন গঙ্গার ঘাটের কথা।
এই ঘাটে বহুবার পদার্পণ করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ সহ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাক্ষাৎ শিষ্যরা। স্বামী বিবেকানন্দ - এই আলোকপুরুষ মাত্র ৩৯ বছর বেঁচে ছিলেন অথচ তাঁর কর্মকাণ্ড হয়ত বা ছিল তিন হাজার ন'শো বছরের। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মানুষটি মানুষকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখালেন। বললেন "জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর"। সেই সেবাব্রত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। গঙ্গার পশ্চিম কূল বারাণসী সমতুল। সেই ভাগীরথী গঙ্গার বেলুড় সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের পূত অস্থি কাঁধে করে বয়ে এনেছিলেন তিনি। গোড়াপত্তন হয় রামকৃষ্ণ মিশনের। গড়ে ওঠে উপাসনা কেন্দ্র, বিশাল মন্দির। হিন্দু মন্দির, মসজিদ এবং গীর্জা - তিন ধর্মের উপাসনা স্থলের গঠনশৈলী মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির। যে রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মকাণ্ড সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে তার প্রধান কর্মকেন্দ্র বেলুড় মঠ। আর সেই বেলুড় মঠ সংলগ্ন এই গঙ্গার ঘাট ভাগিরথীতে নেমে গেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসেন বেলুড় মঠে এই মন্দিরের শোভা দেখতে, শান্তির আশায়, পুণ্যার্জনের জন্য। আর বেলুড় ঘাটে পা রেখে তাঁরা অনুভব করেন সেই চিরশ্রেষ্ঠ মানুষটির উপস্থিতি। কয়েক বছর আগেও এই বেলুড় মঠ সংলগ্ন ঘাটেই শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের জন্মতিথি উপলক্ষে এক অপূর্ব বাজি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো প্রতি বছর। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ এই আতসবাজির প্রদর্শনী শুরু করেছিলেন।
"মধুমাঝির যে নৌকাখানা রাজগঞ্জের ঘাটে বাঁধা" ছিল সেই নৌকাটি নিয়ে ঘুরে এলাম কতগুলো ঘাটে। কবি তো বলেই গেছেন, "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে"। তাদের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলাম একটুখানি। চেষ্টা করেছি আমার লেখার মধ্যে দিয়ে পাঠকবন্ধুদেরও আমার সঙ্গে সেই সব ঘাটে বেড়াতে নিয়ে যেতে। এইবার ঘাট থেকে বিদায় নিই... এরপর আসব মেলায়... মিলিয়ে দিতে।।