"প্রথম আলোয় ফেরা, আঁধার পেরিয়ে এসে আমি / অচেনা নদীর স্রোতে চেনা চেনা ঘাট দেখে নামি" (কবীর সুমন)
হুগলি নদীর তীরে কলকাতায় একটা সাধারণ ঘাট। নাম বাজে কদমতলা ঘাট। খুব সাধারণ, পুকুর বা দিঘীর পাড়ে যেমন বাঁধানো ঘাট থাকে, ঠিক সেইরকমই একটা ঘাট। তা সেই ঘাটেরও অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। ১৮২৬ -এর বন্যায় ভেঙেচুরে একাকার। কিন্তু সেই ঘাটেই কতো মানুষ গঙ্গাস্নান করেন। কতো মানুষ নানাধরনের ধর্মীয় কাজ করেন, করেন পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মও। প্রতিমা বিসর্জন করা হয়। গঙ্গাস্নানের জন্য আসেন কলকাতার সব বিখ্যাত বাড়ির মেয়ে বৌরা। তাঁরা পালকি করে আসেন। পালকি শুদ্ধুই বেহারারা গঙ্গায় ডুবিয়ে আবার তুলে নেয়।
সময়টা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক। বাবু প্রীতরাম মাড় বা প্রীতরাম দাসের তখন ধনী হিসেবে বিশাল নামডাক। তাঁর পুত্রের সঙ্গে বিবাহ হল হালিশহরের এক কন্যার যার নাম রাসমণি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ইনিই সেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ রানী রাসমণি। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন পুত্র বাবু রাজচন্দ্র দাস। তিনি ব্যবসায় অভূতপূর্ব উন্নতি করে পিতার সম্পদকে বহুগুণ বর্ধিত করতে সমর্থ হন। তাঁর দান ধ্যান ও সামাজিক কাজকর্মেরও শেষ ছিল না। তাঁদের বসতবাড়ি ছিল মধ্য কলকাতার জানবাজারে। সেখান থেকে সবথেকে কাছে যে গঙ্গার ঘাটটি ছিল তা হল বাজেকদমতলা ঘাট।
সেখানেই রানী রাসমণি গঙ্গাস্নানে যেতেন। সেই ঘাটের দুরবস্থা দেখে তিনিই তাঁর স্বামীকে পরামর্শ দেন একটি সুন্দর ঘাট তৈরি করার এবং সেইমতো ১৮৩০ সালে তৈরি হল নতুন ঘাট যে ঘাটের নাম রাখা হলো "বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট"; লোকের মুখে মুখে যা দাঁড়ায় "বাবুঘাট"-এ। কলকাতার ইতিহাস অনুযায়ী এই ঘাট কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম ঘাট। ইতিহাস বলছে, রানী রাসমণির অনুরোধে একটি পাকা ঘর এবং এই ঘাট তৈরি করে দিয়েছিলেন বাবু রাজচন্দ্র। একশো নব্বই বছর আগেকার ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতায় বাবুঘাটের স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীর অনুসরণে। বড় বড় থামের উপর ত্রিভুজাকৃতি কাঠামো.. এইভাবেই তৈরি ঘাটের মূল প্রবেশদ্বার। মূল চাতাল থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে গঙ্গার বুকে। একটা বড় ফলকে লেখা রয়েছে প্রতিষ্ঠাতার নাম "This ghat constructed in the year 1830 at the expense of Babu Raj Chandra Das hereafter be called Babu Raj Chandra Das Ghat."
তালতলা এলাকার বিখ্যাত জানবাজারের দুর্গাপুজোর বোধনের নবপত্রিকা আজও এই ঘাটেই স্নান করানো হয়। এই বাবুঘাটে লোকজনদের যাওয়ার সুবিধার জন্যে রাজচন্দ্র চৌরঙ্গি থেকে ঘাট অবধি পাকা চওড়া রাস্তা করিয়ে দিয়েছিলেন বর্তমানে যেটি রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ নামে পরিচিত।
ঘাটের সিংহ দরজার মুখে বড় মার্বেলের ফলকে লেখা লর্ড বেন্টিকের নাম। সেই সময় তিনি এই প্রয়াসকে অনেক প্রশংসা করেছিলেন। সেই কথাও লেখা আছে মার্বেলের ফলকে। রাজচন্দ্র এই ঘাটের পাশেই একটি কলও বসিয়েছিলেন সেইসময় যেটি দিয়ে এই অঞ্চল ধোয়ানো হত গঙ্গা থেকে জল নিয়ে।
তবে এখন সে সব অতীতের কাহিনী হয়ে রয়েছে। শুধু বাঙালির মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে রানী রাসমনির নাম এবং বাবু রাজচন্দ্রের নাম। কলকাতা শহর যতোদিন থাকবে ততদিন কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে বাবুঘাটের নাম।