এবারের যাত্রা আর্মেনিয়ান ঘাট বা বাঙালির ভাষায় "আর্মানি ঘাটের" দিকে। আসলে কলকাতা শহর চিরদিন দেশি বিদেশি সব ধর্মের মানুষকে আপন করে নিজের বুকে টেনে নিয়েছে তাই বিদেশি মানুষরাও এই শহরকেই নিজের ভেবে কত স্থাপত্যের নিদর্শনই না রেখে গেছেন! এই আর্মেনিয়ান ঘাটও কিন্তু একজন বিদেশি মানুষেরই তৈরি করা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসার অনেক আগে থেকে আর্মেনিয়ানরা এই দেশে এসে বসবাস শুরু করেন। আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন তখন তাঁর সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু আর্মেনিয়ান সৈনিক ছিল যারা ভারতে এসে আর ফিরে যায়নি। এই দেশকেই তাদের নিজের দেশ করে নিয়েছিল। আরো পরে সম্রাট আকবর আর্মেনিয়ানদের ব্যবসার জন্য ভারতে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তখন থেকে আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা ভারতে আসা শুরু করেছিলেন। পরে যখন ব্রিটিশরা বা ফরাসীরা এই দেশে আসে, শান্তিপ্রিয় আর্মেনিয়ানদের তাদের সঙ্গে সহাবস্থানে কোনো অসুবিধা হয় নি। দামি রত্ন, অলংকার, জাহাজ, মশলা, মসলিন কাপড় এবং নীল চাষ। আর্মেনিয়ানরা মূলতঃ এইসব জিনিসেরই ব্যবসা করতেন এবং তারা ছিলেন অত্যন্ত ধনী। হুগলি নদীতে নৌকা এবং জাহাজ যাতায়াতের সুবিধার কারণে বহু আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। এই আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীদের একজন ছিলেন ম্যানুয়েল হাজারমালিয়াঁ। তার মশলা এবং গয়নার ব্যবসা ছিল। হুগলি নদীতে যাতে তার অলঙ্কারের এবং মশলার নৌকা ঠিকঠাক ভাবে চলাচল করতে পারে আর কলকাতায় এসে তীরে ভিড়তে পারে তার জন্য তিনি ১৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দে একটি ঘাট তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই ঘাট থেকেই তাঁর ব্যবসার জিনিসপত্র আমদানি রফতানি হতো। এই ঘাটই পরবর্তী সময়ে আর্মেনিয়ান ঘাট নামে পরিচিত হয়। ম্যানুয়েল হাজারমালিয়াঁ এই ঘাট ছাড়াও আর্মেনিয়ান চার্চের চূড়া এবং একটি ঘন্টাঘরও তৈরি করে দিয়েছিলেন।
আর্মেনিয়ান ঘাটের গুরুত্ব কম ছিল না সেইসময়। কলকাতায় প্রথম ট্রাম চালু করা হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি। এটা ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম এবং এর যাত্রাপথ ছিল কলকাতার শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত। অবশ্য কয়েক বছর পর এই ঘোড়াচালিত ট্রাম সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম যখন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হল তখন এই আর্মেনিয়ান ঘাটে ১৮৫৪ থেকে ১৮৭৪ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলের কলকাতা স্টেশন এবং রেলের টিকিট-ঘর ছিল। এখানেই রেলযাত্রীরা টিকিট কিনত এবং জিনিসপত্র ওজন করিয়ে তার ভাড়াও দিয়ে দিত। তারপর রেল কোম্পানির লঞ্চ এই ঘাট থেকেই যাত্রীদের নদী পার করিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিত। কিন্তু ১৮৭৪ -এ হাওড়ার ব্রিজ (প্রথম) তৈরি হওয়ার পর কলকাতা স্টেশন হাওড়ায় চলে যায়। এরপর থেকে আর্মেনিয়ান ঘাটের গুরুত্বও কমে আসে।
আজ কলকাতা শহরে আর্মেনিয়ানরাও সংখ্যায় গুটি কতক রয়েছেন। তাঁরা আর আগের মতো ধনীও নেই। তবুও কলকাতা শহরে আর্মেনিয়ান ধনপতিদের তৈরি বহু বড় বড় প্রাসাদের সঙ্গেই তাঁদের একসময়ের সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করছে এই আর্মেনিয়ান ঘাট।
তথ্যসূত্র: কলিকাতা দর্পণ-রাধারমণ মিত্র