মাটির বাড়ি, মাটির বাসন, মাটির কুঁজো, খসখস, তালপাতার পাখা, বারান্দার মখমলি বাতাস -এসবই এখন অতীত, পুরোটাই এখন 'নস্ট্যালজিক-ন্যাচারাল' ফ্যাশন। তবে এককালে গোটা একটা গরমকাল জুড়িয়ে যেত এই 'নস্ট্যালজিক-ন্যাচারাল' উপাদানের উদারতায়। কী একটা 'গ্লোবালাইজেশন' হল আর পাল্টে গেল পুরো পটভূমিকাই। 'গ্লোবালাইজেশ'ন আর 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং', যেন একই বৃন্তে দু'টি কুসুম। একমাত্র উচ্চবিত্তের নাগালে থাকা যাবতীয় আরাম সামগ্রী ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল সমাজের সর্বস্তরের অন্তরে-অন্দরে। হু-হু করে জনজীবনে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করল রকমারি ডিজাইনার সিলিং ফ্যান, এয়ার কুলার, এ সি মেশিন, 'বিদুৎ বাঁচানো' তকমা আঁটা ছোট থেকে বড় নানামাপের ফ্রিজ। কিন্তু, এসব করে কী হল?
এসব করে আমরাই বরং চড় চড় করে বাড়তে সাহায্য করলাম বিশ্ব উষ্ণায়নের পারদকে। আজ মানুষের এই 'পাখি পড়া' জীবন, ফুরসৎহীন জীবন যে অভ্যাসের ফাঁদে পড়েছে তাতে প্রকৃতির সঙ্গে কৃত্রিমের বৈরীতা বাড়বে বই কমবে না। বিশ্বায়ন অথবা গ্লোবালাইজেশনের আগে জনজীবনে না ছিল এত ব্যস্ততা, না ছিল অসহনীয়ভাব। এখন ব্যস্ততম জীবনে সহ্যশক্তি হারিয়ে রাতদিন যান্ত্রিক ঠান্ডার ঘেরাটোপে থাকতে চাই আমরা, যাঁরা এখনও 'ফ্যান'-জীবী তাঁদের তো জীবন ওষ্ঠাগত, স্ট্যান্ড ফ্যান-সিলিং ফ্যান সহযোগেও গরমের থেকে রেহাই পাচ্ছেন না তাঁরা, ফ্রিজের জল ছাড়া তেষ্টা মেটানোর কথা ভাবতে পারেন না কেউই। এতদিন ধরে নানা সমীক্ষা থেকে আমরা বার বার জেনেছি অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক্স ব্যবহারের ফলে যে যে সমস্যার সম্মুখীন আমরা হয়ে চলেছি তার মধ্যে বিরাটতম সমস্যা হল বিশ্ব উষ্ণায়ন। কিন্তু এসব জেনেও আমরা জীবনযাপনের সামগ্রিক 'উন্নয়ন' আর 'অসহনীয়তা'র দোহাই দিয়ে খাল কেটে কুমির এনে চলেছি, যার ফলও পাচ্ছি হাতে নাতে। তাই বলে হাল ছেড়ে দেওয়াটাও তো কাজের বিষয় নয়, তাই না? চেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে, অদৃষ্ট আমাদের হয়ে চেষ্টা করে দিয়ে যাবে তা তো আর হয় না! তাই-
মাটির কুঁজো বা জালা-কে এড়িয়ে যাবেন না, সারা বছর ফ্রিজের জল না খেয়ে ঠিক যেমনভাবে ফ্রিজে অভ্যস্ত হয়েছিলেন, তেমনভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠুন না এই পুরনো পন্থায়...দেখবেন তেষ্টার তৃপ্তি আপনি পাবেনই। মাটি কুঁজো জল পরিষোধক, সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না। একটু মাটির কাছাকাছি থাকলে মাটিও আপনাকে পৌঁছে দেবে তার শীতলতা।
ব্যবহার করুণ 'শীতলপাটি'। সেটা কী? এ প্রজন্মের তরফে এ প্রশ্ন একেবারে ধরা বাঁধা; যাঁরা জানেন তাঁদের পালটা প্রশ্ন 'এখনও পাওয়া যায়?'। হ্যাঁ, পাওয়া যায় তো বটেই, শুধু শহুরে অত্যাধুনিক মানুষ তার খোঁজ রাখেন না। এখনও কোচবিহার জেলায় রমরম করে বেঁচে আছে এই কুটিরশিল্প। তুফানগঞ্জ, মাথাভাঙ্গা, দিনহাটা ব্লকের হাজার হাজার মানুষের জীবিকা শীতলপাটি। অসীম ধৈর্য আর পরিশ্রমে তাঁরা তা তৈরী করেন। তৈরীর প্রক্রিয়াটা এখানে একটু বলে রাখা বাঞ্ছনীয়, এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হল বেতগাছ। এই বেতের ছাল থেকেই তৈরী হয় শীতলপাটি। প্রথমে জমি থেকে বেত কাটা হয়, তারপর তা হালকা শুকিয়ে নিয়ে ধারালো যন্ত্র দিয়ে চিরে নিয়ে কিছু বেত আবার সিদ্ধ করা হয়, তাকে বলে সিদ্ধ পাটি। এভাবে পাঁচ থেকে ছয় রকমের পাটি তৈরী করা যায়। সাধারণ পাটি হল- মোটা পাটি, সরু পাটি হল- ভূষণাই, এই পাটিই বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তৈরী হয়- কম্বল পোষপাটি। গরমের সময় বিছানা বা মেঝেতে শীতলপাটি পেতে শুয়ে যে আরাম পাওয়া যেত তা এখন অপূরণীয়।
একটু কষ্ট করে বিকেল অথবা সন্ধের একটা সময় বেছে নিয়ে ফ্যান বা এ সি বন্ধ করে খুলে দিন জানালা দরজা, হাওয়া খেলুক ঘরে। তালপাতার নক্সী পাখা ঘর সাজানোর শো'পিস করতে চাইলে করুণ এছাড়াও এটিকে হাতে রাখুন, মাঝে মধ্যে হাত দুলিয়ে শরীরে বুলিয়ে নিন তালপাতার ঠান্ডা বাতাস। আগেকার দিনে সূর্যের দাবদহ আর তপ্ত লু আটকানোর মক্ষম দাওয়াই ছিল 'খসখস'; শৌখিন পর্দা ভাঁজ করে রেখে গরমকালে খসখস টাঙান জানলায়। এতে বাইরের তাপ সবচেয়ে ভাল আটকানো যায়। আগে ঘরে-অফিস-কাছারিতে খসখস জলে ভিজিয়ে দেওয়া হত আর তাতে পাওয়া যেত হিমশীতল হাওয়া, সে শান্তির কাছে এ সি, ফ্যান ছিল নস্যি। কাচের জানলা যাঁদের, তাঁরা খসখসের বদলে শৌখিন 'ব্লাইন্ডস' লাগাতে পারেন। এতেও পুরোপুরি আটকানো যায় বাইরের তাপ। আপনার ঘরের অতিরিক্ত গরম শুষতে গিয়ে কিন্তু এ সি বাবাজিরও ক্লান্তির জিভ বেরিয়ে আসে আর মাস গেলে আপনার হাতে এসে পোঁছায় চোখ ধাঁধানো বৈদ্যুতিক বিল।
আর অপরিহার্যভাবে গাছের সংস্পর্শে আপনাকে থাকতেই হবে, কারণ কংক্রিট/উন্নয়ণ আপনাকে আর যাই দিক জীবন দিতে পারবে না। নগরোন্নয়নের স্বার্থে আমরা যথেচ্ছ গাছ মেরে ফেলেছি, এখনও ফেলছি। সচেতনতামূলক প্রচারে অবশ্য একটু আধটু কাজ হয়েছে, আজকাল ফ্ল্যাটবাড়িতে সবাই এক চিলতে 'ব্যালকনি'র খোঁজ করে, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য-গাছ লাগানোর জন্য, ছোট হলেও এ উদ্যোগ তবু ভাল কারণ প্রকৃতির ভারসাম্য পিরামিড গুলিয়ে গিয়েছে অনেকদিন আগেই। গাছ থাকবে, ছায়া থাকবে, মাটি হবে ঠান্ডা, গাছে ধরবে রঙবেরঙের ফুল-ফল, তার টানে আসবে মৌমাছি-প্রজাপতি-চড়াই-ঘুঘু-শালিকের দল -এ মানচিত্র গিয়েছে পাল্টে।
মনে রাখবেন আপনি যন্ত্র নন, যন্ত্রী। আপনি যেমন চালাবেন তেমনই চলবে এ ধরাধাম। তাই পাল্টে যাওয়া মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার চাবিকাঠি কিন্তু আপনার হাতেই রয়েছে, আপনি চাইলেই খুলে দিতে পারেন মনের যাবতীয় অস্থির আগল। তাই সমূহ বিপদকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মনে প্রানে বেঁধে নিন এই কথাটি- 'দাও ফিরে সে বিশ্বপ্রকৃতি, লও এ বিশ্ব উষ্ণায়ন'।