নীতিন বসু: ভারতীয় সিনেমায় আধুনিকতার অন্যতম পুরোধা

বাংলা সিনেমার আদিপর্বের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী চিত্রপরিচালক ও চিত্রগ্রাহক হলেন নীতিন বসু। তাঁর জন্ম স্বাধীনতাপূর্বের কলকাতায়। বাবার নাম, হেমেন্দ্রমোহন বসু; যিনি, ‘এইচ. বোস’ নামে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি তৎকালীন বাংলার সংস্কৃতি-জগতে, ব্যবসায়, উদ্যোগে, কারিগরীতে ছিলেন প্রবাদ-পুরুষ। তাঁর উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত চুলের তেল ‘কুন্তলীন’, সুগন্ধী ‘দেলখোস’ এবং পান সুবাসিত করার মশলা ‘তাম্বুলীন’ বাংলা ও বিদেশের বাজারে বাঙালির সুনাম বিতরণ করেছে দীর্ঘকাল। এই সব দ্রব্যের বিজ্ঞাপন তিনি ছড়ার আকারে নিজেই রচনা করেছিলেন, যা বাঙালির মুখে মুখে ফিরত সেই সময়—

‘কেশে মাখো কুন্তলীন, রুমালেতে দেলখোস,

পানে খাও তাম্বুলীন, ধন্য হোক এইচ বোস।’

তেল-সুগন্ধী ছাড়াও তিনি বিখ্যাত কুন্তলীন পুরস্কার প্রবর্তন করেছিলেন। কুন্তলীন প্রেস স্থাপন করেছিলেন, রেকর্ড তৈরি ও ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রকণ্ঠ রেকর্ডে ধারণ তাঁরই কীর্তি। এছাড়া সাইকেল, মোটরগাড়ি, ক্যামেরা, সিনেমাটোগ্রাফি প্রভৃতি মনোহারী ও শৌখিন জিনিষ যা কিছু বিশ্বের বাজারে উদ্ভাবিত হয়েছিল সেকালে, তাকেই বাংলা-বাজারে বিপণনের জন্য আমদানি করতেন  তিনি। বাঙালি যে ব্যবসা বিমুখ নয়, বাঙালির যে উদ্যোগের অভাব নেই—সেটাই তিনি প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন। এমন একজন পিতার পুত্র ছিলেন নীতিন বসু। পিতার চরিত্রের প্যাশন, উদ্যম ও অধ্যাবসায় তাঁর চরিত্রেও বহাল তবিয়তে বর্তেছিল।

বিশ শতকের প্রথম দশকে গ্রামোফোন রেকর্ড ও ফটোগ্রাফিচর্চার জোয়ার যখন এ-বঙ্গে কতিপয় মানুষের মধ্য দিয়ে প্রসারিত হবার সুযোগ করে নিচ্ছে, তখনই তাতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এইচ. বোস। ফটোগ্রাফিচর্চা এই সময় হয়ে উঠেছিল তাঁর প্যাশন এবং এই প্যাশন সচেতনভাবেই তিনি ছেলের মধ্যেও চারিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে, কিশোরকালেই নীতিন স্টিলফটোগ্রাফিতে হাত পাকাবার ও এই মাধ্যমকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছিলেন। কেননা, বাবা ঐ সময়েই তাঁকে একটি স্টিল ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। তারপর যখন স্কুল ছেড়ে কলেজ যেতে শুরু করলেন, তখন বাবা তাঁকে একটা মুভি ক্যামেরাও কিনে দিলেন। সেই সময় র-ফিল্মের দাম ছিল অত্যন্ত সস্তা। ফলে, এন্তার ছবি তোলায় বাধা ছিল না। তখন সমগ্র কলকাতায় নিজস্ব মুভি ক্যামেরা আছে—এমন মানুষ সত্যিই বিরল ছিলেন। নীতিন এই বিরল সৌভাগ্যকে ভালোভাবেই কাজে লাগালেন। চলচ্চিত্র তোলায় সিদ্ধহস্ত হয়েই অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য নিউজ রিল ও ব্যক্তিগত ছবি তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন। ১৯২১-২২ সাল নাগাদ একে একে পুরীর রথযাত্রা ও ত্রিপুরার মহারাজার হাতিশিকারের ঘটনা চলচ্চিত্রে বন্দি করলেন।

এভাবেই চলতে চলতে বাংলার নবগঠিত সিনেমাজগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠল। এল ১৯২৭ সাল। ততদিনে চিত্রগ্রহণে তিনি বেশ অভিজ্ঞতা লাভ করে ফেলেছেন। এ-কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতেও মনস্থির করে ফেলেছেন। কাজেই সুযোগ পেতেই ইন্ডিয়ান কিনেমা আর্টস সিনেমা-সংস্থায় চিত্রগ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়ে গেলেন। তাঁদের ব্যানারে বাংলা ছায়াছবিতে প্রথম কাজ করলেন ‘পুনর্জন্ম’ ছবিতে। এরপর ১৯২৮ সালে নরেশচন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘দেবদাস’ ছবিতেও চিত্রগ্রহণ করলেন। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এটিই ছিল ‘দেবদাস’-এর প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ।

Nitin-Bose-still

তারপর ১৯৩০ সালে হঠাৎ-ই তাঁর সুযোগ ঘটে গেল ছায়াছবি পরিচালনার। ছিলেন চিত্রগ্রাহক, এবার হয়ে উঠলেন চিত্রপরিচালকও। ছবির নাম, ‘বুকের বোঝা’। প্রযোজনায় আর্য ফিল্মস। আসলে পরিচালক মধু বসু এই ছবি পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু প্রযোজক হরেন ঘোষের সঙ্গে সংঘাতের ফলে তিনি মাঝপথে কাজ ছেড়ে চলে গেলেন। তখন নীতিনের ওপরেই দায়িত্ব বর্তাল ছবি সম্পূর্ণ করার। এবং, নীতিন যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করলেন। তবে এই সাফল্যের পরই পাকাপাকিভাবে চিত্রপরিচালনায় নেমে পড়লেন না তিনি। আরও সময় নিলেন নিজেকে তৈরি করতে।

১৯৩০ সালেই নীতিন যোগ দিলেন সুবিখ্যাত নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয়। যোগ দিলেন ক্যামেরা বিভাগের প্রধান ও মুখ্য কারিগরী উপদেষ্টা হিসেবে। এখানে নিত্যনতুন তাঁর মুকুটে যোগ হতে লাগল একের পর এক পালক। দেবকীকুমার বসু’র ‘চণ্ডীদাস’ (১৯৩২) ছায়াচিত্রে তিনি যেমন চিত্রগ্রহণের কাজ করার সুযোগ পেলেন, তেমনি প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর পরিচালনায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ সবাক ছায়াছবি ‘দেনা পাওনা’ (১৯৩১)-তেও চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ছবি ‘নটীর পূজা’ (১৯৩২)—তাতেও তিনি চিত্রগ্রাহক।

১৯৩৪ সাল। সুযোগ ঘটল চিত্রগ্রহণের পাশাপাশি চিত্রপরিচালনার। ‘চণ্ডীদাস’ ছবির হিন্দি ভারসানটি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকেই দিল নিউ থিয়েটার্স। ছবিতে কে এল সায়গল অভিনয় করলেন ‘চণ্ডীদাস’ চরিত্রে এবং ‘রামী’ চরিত্রে অভিনয় করলেন উমাশশী। তাঁদের অসাধারণ অভিনয়ধন্য রোমান্টিক গীতিমুখর এই ছবিটি ব্যাপক সাফল্য করল। এই ছবির মধ্য দিয়েই হিন্দি ছায়াচিত্র প্রযোজনায় নিউ থিয়েটার্স প্রথম সাফল্য লাভ করল। ফলে, এরপর নীতিন বসু পাকাপাকিভাবেই এই স্টুডিওর চিত্রগ্রাহক ও চিত্রপরিচালক হয়ে উঠলেন। এবং তৈরি করতে লাগলেন একের পর এক ইতিহাস। পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে ‘ভাগ্যচক্র’ ছবির মধ্য দিয়ে তিনি ভারতীয় ছবিতে প্রথম প্লে-ব্যাক সিস্টেমের প্রবর্তন করলেন।

তারপর অসংখ্য সফল ছবির ধারা বেয়ে ১৯৪১ সালে ‘পরিচয়’ ছবিটি পরিচালনা করলেন নীতিন বসু। এই ছবিতেই কানন দেবী নিউ থিয়েটার্স-এর ব্যানারে শেষবারের মতো অভিনয় করলেন। কানন দেবী তাঁর ‘সবারে আমি নমি’ আত্মকথায় ‘পরিচয়’ প্রসঙ্গে নীতিন বসুর পরিচালনা-পদ্ধতি সম্পর্কে লিখলেনঃ

“নীতিন বসুর পরিচালনায় এই আমার প্রথম ছবি। নীতিনবাবু অভিনয়, চলাফেরার ব্যাপার আমাদের ওপরেই ছেড়ে দিতেন। ওঁর সমস্ত লক্ষ্যটাই ছিল ফটোগ্রাফির দিকে। কোন অ্যাঙ্গেল থেকে কোন বিশেষ ভঙ্গিতে ছবি নিলে অভিনীত চরিত্রগুলির বক্তব্য সেই কম্পোজিশনের মধ্য দিয়ে প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে তাই ছিল যেন ওঁর বিশেষ অভিনিবেশের বিষয়। ক্যামেরা দিয়েই উনি চরিত্রকে কথা বলাবার প্রয়াসী ছিলেন। ‘অন্যমনস্ক মুডের কোনো একটি ভঙ্গীতে মানুষ যেভাবে ধরা পড়ে, কথাবার্তায় অতটা নয়। কারণ অসতর্ক মুহূর্তে নিজেদের ভাব ও ভাবনাকে সাজাবার অবকাশ থাকে না।’ এটা ছিল তাঁর প্রায়োক্তি। Art is never an exhibition but revelation. এই নীতিতেই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।”

কানন দেবীর এই বক্তব্য থেকে নীতিন বসুর দুটো দিক আমরা পাচ্ছিঃ এক,  পরিচালকের আসনে বসেও তিনি চিত্রগ্রহণকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। দুই, ছায়াছবি যে থিয়েটারের ফটোগ্রাফি নয়, ছায়াছবিতে ক্যামেরাও যে কথা বলে—এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ তাঁর কাজে তিনি পূর্ণমাত্রায় করে দেখিয়েছিলেন। সেজন্যই পরিচালনায় আসার পূর্বে সত্যজিৎ রায় নিয়মিত নীতিন বসু পরিচালিত ছায়াছবি দেখতেন। আত্মীয়তার সূত্রে মাঝে মাঝে তাঁর সেটে গিয়েও কাছ থেকে কাজ দেখতেন। সত্যজিৎ যেহেতু আঁকায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তাই সেই সময় নীতিন তাঁকে আর্ট ডিরেক্টার হওয়ার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন।

সত্যি বলতে কী, নীতিন বসু ছিলেন নিউ থিয়েটার্স-এর রত্ন। তাই তিনি যখন কলকাতা ছেড়ে নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে বম্বে চলে গেলেন, তার পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল নিউ থিয়েটার্স-এর পতন।

যাই হোক, ১৯৪১ সালে বম্বে গিয়ে নীতিনের জমিয়ে নিতে দেরি হল না। একে একে পরিচালনা করলেন ‘মিলন’ (১৯৪৬), ‘দিদার’ (১৯৫১), ‘সমর’ (১৯৫০), ‘ওয়ারিশ’ (১৯৫৪) ও ‘গঙ্গা-যমুনা’ (১৯৬১)’র মতো অসম্ভব সফল সব ছবি। ‘গঙ্গা-যমুনা’র সাফল্য ও গল্প পরবর্তীকালের হিন্দি ছবিকেও প্রভাবিত করল। কেননা, এই ছবি থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছিল অমিতাভ বচ্চন ও শশী কাপুর অভিনীত আরেক অসম্ভব সফল ছবি ‘দিবার’ (১৯৭৫)।

Nitin-Bose-Stamp

ব্যক্তিগত জীবনে নীতিন বসু ছিলেন অত্যন্ত সহৃদয় এক মানুষ। তাঁর পরে পাহাড়ী সান্যাল নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে যখন বম্বে গিয়ে কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না, তখন তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পায়ের তলায় শক্ত মাটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এই নীতিন বসুই। তাঁর ‘মিলন’ ছবিতে অভিনয় করেই পাহাড়ী পেয়েছিলেন সেখানে প্রতিষ্ঠা। নিউ থিয়েটার্স-এর শব্দগ্রাহক তপন সিনহাকে নীতিনই চিত্রপরিচালক হয়ে উঠতে প্রণোদিত করেছিলেন। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক বিমল রায়কে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ক্যামেরার কাজ। এমনকি দিলীপকুমার, যিনি অভিনয়ের নিজস্ব ধারার জন্য বিখ্যাত; সেই ধারাটি গড়ে তোলার পেছনেও ছিল নীতিনের অবদান।

নীতিন বসুর ছবিগুলোতে বিষয় বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো।  প্রতিটি ছবিতেই স্থান পেয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক সমস্যা। এই যে সমাজ সচেতনতা, তাকে মূলধারার উত্তরাধিকারে তিনি চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন ভারতীয় সিনেমার ধারায় ক্যামেরাকে কথা বলানোর রুচি তৈরি করে দিতে। নিছক সংলাপধর্মীতা যে চলচ্চিত্রের অঙ্গহানি ঘটায়--এই বোধকেও প্রতিষ্ঠা করে যেতে তিনি পেরেছিলেন। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তাঁর এই অবদানমালা ভোলার নয়। তাই তাঁর ছবি আজও আমাদের শেখায়, আমাদের জাগায়, আমাদের ভাবায়। কালজয়ী চলচ্চিত্রশিল্পী হিসেবে এখানেই তাঁর জয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...