ইয়াদ করোগে, ইয়াদ করোগে, একদিন হামে ইয়াদ করোগে...
মনে করবে, মনে করবে, একদিন আমায় মনে করবে। শব্দগুলোর জন্ম যেন তাঁর জন্যই। কী এক অমোঘ টান। খাঁ-খাঁ শূন্যতা বুকে নিয়ে বয়ে যাওয়া।
এ কণ্ঠের মাদকতায় ডুব দিলে আর নিস্তার নেই। শ্রোতাকে অতলে তলিয়ে দেওয়াই তার অনিবার্য নিয়তি।
চোখের তারায় হরিণী দৃষ্টি, তিল ফুলের মতো নাক, কাটাকাটা চোখ-মুখ। অমরাবতীর কিন্নরী। যার কণ্ঠে স্বয়ং ঈশ্বরীর বাস।
ভক্তিমূলক গান দিয়ে শুরু করেছিলেন তাঁর সঙ্গীত সফর। শচীন কত্তার মানসপুত্রী। এই মানুষটিই বদলে দিয়েছিলেন তাঁর গায়িকা জীবনের গতিমুখ। মাত্র চল্লিশে ফুরিয়ে যাওয়া গান্ধর্বী গায়িকার জন্য তুলে রাখা গান তিনি আর কাউকে দিতে পারেননি ইহজীবনে।
ডাকাতিয়া বাঁশির ডাকে তেমনভাবে আর যে কেউ সাড়া দিতে পারে না, ঠিক যেমন ভাবে সাড়া দিয়ে উঠতে পারেন হরিণী দৃষ্টির সেই চঞ্চল গায়িকা। গীতা রায়চৌধুরী ওরফে গীতা দত্ত।
বাংলাদেশের ফরিদপুরের জমিদার বাড়ির মেয়ে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায় চৌধুরীর দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। ১৯৩০ সালে জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছারখার করে দিল অভিজাত পরিবারটিকে। নিজের মাটি ছেড়ে আশ্রয় নিতে হল পরদেশে। কলকাতায়। জল-মাটি-শালিখ-ফড়িং-এর জীবন ছেড়ে বহুদূরে। অনিশ্চিত, টালমাটাল সময়ে প্রবেশ করে ফরিদপুরের জমিদার পরিবারটি।
১৯৪২ সাল নাগাদ সপরিবারে বোম্বাই পাড়ি দিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায় চৌধুরী।
বোম্বাই অধুনা মুম্বই-এর ঘিঞ্জি দাদার অঞ্চল। এক চিলতে অ্যাপার্টমেন্ট। গীতার বয়স তখন বছর বারো।
আর্থিক দুর্গতি চরমে। সংসারের সুরাহার জন্য গানের টিউশনি করতেন গীতা। ফরিদপুরের জলহাওয়ায় ভূমিকন্যার গলায় ছিল ভাটিয়ালি আর দেশজ গানের সুরের বুনন। দশফুট বাই দশফুট বন্দি জীবনে ফুসফুস ছিল বারান্দা। দাদারের স্কাইলাইন নয়নাভিরাম ছিল না। কিন্তু গীতার আনমনের সুরে জেগে উঠত বারান্দাখানা। সেই সুর একদিন কানে গেল সঙ্গীত পরিচালক হনুমান প্রসাদের। হিরে চিনেছিলেন হনুমান প্রসাদ। সুযোগ দিলেন বছর ষোলোর কিশোরীটিকে।
সালটা ১৯৪৬। ভক্ত প্রহ্লাদ ছবি দিয়ে প্লেব্যাক দুনিয়ায় প্রবেশ। তাঁর ছবিতেই প্রথম গান গাইলেন গীতা। কোরাসে মাত্র দু’লাইনের গান।
পরের বছরই ‘দো ভাই’ ছবিতে প্লে ব্যাকে সুযোগ। গীতার গানের মোড় ঘোরালেন শচীন দেব বর্মণ। কামিনী কৌশলের লিপে ‘মেরা সুন্দর দিন বীত গ্যায়া হ্যায়’ জাদু করল দর্শকদের। গানের রেটিং-এ একেবারে টপে।
স্বাধীনতা, দেশভাগে রক্তাক্ত ভারত যেন কোকিল ধ্বনি শুনল। রাতারাতি সেরা গায়িকাদের তালিকায় জায়গা করে নিলেন গীতা ঘোষ রায় চৌধুরী।
১৯৪৯-এ ‘মহল’ আর ‘বরসাত’-এর আগে পর্যন্ত গীতাই এক নম্বরে। ১৯৫০- এ আবার ফিরলেন তিনি। ‘যোগান’ ছবিতে নার্গিসের লিপে ৯ টি ভজন গেয়েছিলেন গীতা। ১৯৫১ তে ‘বাজি’। রাতারাতি কেরিয়ারের মোড় ঘুরে গেল তাঁর। যে কণ্ঠে এত দিন ভজন আর ভক্তি রসের গানে আপ্লুত করেছিল শ্রোতদের সেই কণ্ঠেই এবার জ্যাজ মিউজিকের মদির আবেদন। তদবীর সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বানালে… লাস্যে, বিহঙ্গে ছক ভেঙে বেরিয়ে নতুন গীতা এলেন। সুরের মূর্ছনায় ভেসে গেল আসমুদ্র হিমাচল। মদনমোহন, নৌশাদ, ও পি নাইয়ারের সঙ্গে একটার পর একটা হিট।
গুজরাটি গানেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষের সুরে বাংলা গান।
বাংলা চলচ্চিত্রের গানে এবং আধুনিক বাংলা গানেও গীতা রায় চৌধুরী সোনা ঝরিয়ে ছিলেন। হারানো সুর, হসপিটাল, পৃথিবী আমারে চায়।
‘ইন্দ্রাণী’র ‘ঝনক ঝনক কাঁকন বাজে’, ‘ডাকহরকরা’ ছবির ‘কাচের ছড়ির ছটায় ছেঁয়াবাজির ছলনা’, ‘সোনার হরিণ’-এর ‘তোমার দু’টি চোখে’ গানগুলো বাংলা গানে রোদ্দুরের মতো।
পঞ্চাশের দশকে শুধু কেরিয়ার নয়, তাঁর জীবনও অন্য দিকে বাঁক নিল।
গান রেকর্ড করতে গিয়ে দেখা হল গুরু দত্তের সঙ্গে। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মোহিত গুরু দত্ত। ১৯৫৩ তে বিয়ে করলেন গীতা-গুরু। রূপকথার মত বিয়ে।
কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন সুখের হল না। বিপরীত মানসিকতার দুই ব্যক্তিত্ব। গুরু দত্ত শান্ত ধীর। গান, সিনেমা চিত্রনাট্যে ডুবে থাকা মানুষ। সব ক্ষেত্রে সফল গীতা দত্ত শরতের আকাশের মত। এই উচ্ছ্বল হাসি। পর মুহূর্তেই মেঘে ম্লান। কিন্তু নিজেকে উজাড় করে দিতেন শব্দে-সুরে, রাগ রাগিনীর অন্তরমহলে।
১৯৫৭ সাল নাগাদ ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে নাম জড়িয়ে পড়ল গুরু দত্তের। ঝড় উঠল গীতার জীবনে। টানাপোড়েনের জেরে গুরু এবং গীতা দুজনেই ক্রমশ মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়লেন।
লাগাম ছাড়া নেশা আর অবসাদের জেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন গুরু দত্ত। দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা। তৃতীয়বার আর ফিরতে পারলেন না। ১৯৬৪ সালে ১০ অক্টোবর মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ ও অ্যালকোহলের বিষক্রিয়া ৩৯ বছর বয়সী মারা গেলেন বসন্ত কুমার পাডুকোন, ওরফে গুরু দত্ত৷ বেড রুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁকে।
গুরু দত্তের মৃত্যু গীতা আরও ভেঙে পড়লেন। মাঝ সমুদ্রে হাল ভাঙা দোমড়ানো-মোচড়ানো নৌকার মতো অবস্থা হয় তাঁর। আরও বেড়ে যায় সুরার মাত্রা। আর্থিক সংকট তীব্র। গানের জগত তাঁকে যেন ভুলে গিয়েছে। ছোট ছোট তিন ছেলে মেয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব। আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেন শিল্পী। বাংলা- হিন্দি গানের জগতে। আর্থিক কারণে সিনেমাতেও মুখ দেখাতে রাজী। ‘বধূ বরণ’ নামে একটি ছবিতে অভিনয়ও করলেন।
ভাঙা শরীর, হাড় ভাঙা খাটুনি, অবসাদ, একাকীত্ব, মৃত্যু শোক, বিপর্যয় নেশা দিয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা।
১৯৭১-এ বাসু ভট্টাচার্জের ছবিতে একক কন্ঠের তিনটে গান মেরা দিল যো মেরা হোতা’, ‘কোই চুপকে সে আ কে’ এবং ‘মেরি জান মুঝে জান না কহো’।
শারীরিক অবস্থা চূড়ান্ত খারাপের দিকে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ২০ জুলাই মাত্র চিরতরে থেমে গেল কিন্নরী কণ্ঠের গান। জীবনের বিষাদ গরল ধারণ করতে করতে লিভারে সিরোসিস। মাত্র চল্লিশ বছরের আয়ুষ্কাল। কিন্তু হর্ষ, বেদনা, বিষাদ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি শিল্পের কাছে বন্দক রেখেছিলেন।
আকণ্ঠ বিষাদ পান করেছেন সুরের জীবনে।