মাত্র পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এক একুশ বছর বয়সি মারাঠি ছেলে, তাঁকে নিয়েই ক্যালিপ্সো বেঁধেছিল পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মানুষ। অভিষেকেই ম্যাজিক। পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন ভারতের অধিনায়ক। সুনীল মনোহর গাভাসকার, অনুরাগীদের আদরের নামে সানি। প্রথম দশ হাজার টেস্ট রান ও ৩৪টি শতরানের মালিক হওয়া ব্যাটসম্যান। আমাদের লিটল মাস্টার। রাজার মতোই বিদায় জানিয়েছিলেন বাইশ গজকে। ১৯৮৭-তে ছেড়েছিলেন ক্রিকেট, আর তাঁর রেকর্ড ভাঙলেন আরেক লিটল মাস্টার, ২০০৫-এ।
১৯৮৭-র পর কেটে গিয়েছে পাঁচ বছর। '৯২-এর ভারত তখন উত্তাল। বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে, দেশ জুড়ে জ্বলছে আগুন। ব্যতিক্রম নয় বাণিজ্যনগরী মুম্বইও। জ্বলল মুম্বই, দাঙ্গায় হাজারের উপর মানুষ মারা গেলেন। এই ঘটনা ডিসেম্বরের।
ঠিক পরের বছর ১৯৯৩-এর ১২ মার্চ, বাবরির ফিরতি প্রতিশোধের দাপটে কেঁপে উঠল মুম্বই। ধারাবাহিক ভাবে বাণিজ্যনগরীর নানান জায়গায় ১২টি বিস্ফোরণ। এবার বলি হলেন ২৫৭ জন নিরীহ সাধারণ মানুষ। ফের শুরু হল দাঙ্গা। রক্তের হোলিতে রেঙে উঠল মুম্বাই।
এমনই এক দাঙ্গা দিনের ঘটনা। খর্বদেহী, জেন্টেলম্যান'স গেমের জেন্টেলম্যান, যাঁকে মাঠে খুব একটা রাগতে দেখা যেত না, তিনি জ্বলে উঠলেন।
খেলা ছেড়েছেন ছ-বছর হল। শরীরচর্চার অভ্যেস যায়নি। সদ্য ঘাম ঝরিয়ে ফিরেছেন স্পোর্টসফিল্ডে। বান্দ্রা-ওরলি সি লিঙ্কের আবাসনে, তখন ভারতের তাবড় তাবড় ক্রীড়াতারকাদের বাস। এই বাড়ির নয় তলায় ভারতের ১২ জন ক্রিকেটার থাকতেন। তার মধ্যে ৬ জন কোনও-না-কোনও সময়ে ভারতের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছেন। আন্তর্জাতিক টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় থেকে শুরু করে, ভারতের হকি অধিনায়ক, বিশ্বের বিলিয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন, কে না থাকতেন সেই আবাসনে।
এই আবাসন থেকেই হঠাৎ চিৎকার শুনলেন সুনীল গাভাসকার। রবীন্দ্রনাথের 'আফ্রিকা'-র মতো মানুষ ধরার দলের হুঙ্কার। নখ যাদের নেকড়ের থেকেও তীক্ষ্ণ ছিল, তারাই তাড়া করল একটি গাড়িকে। গাভাসকার এর আগে অনেক চিৎকার শুনেছেন, তাঁর হয়ে, তাঁর দলের হয়ে অনুরাগীদের চিৎকার, তাঁর বড্ড চেনা ছিল। কিন্তু এই রক্তপিপাসুদের চিৎকার ছিল একেবারে আলাদা। গাড়ির উপর চলছে ইটবৃষ্টি। উত্তেজিত জনতা মানুষ শিকারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকের হাতেই খোলা ছুরি তরবারি, মানুষ শিকার হবেই। নৃশংসতার ইতিহাসে হয়ত মুম্বই-এর রাজপথের নামেও সেদিন এক পাতা বরাদ্দ থাকত। কিন্তু হল উলটপুরাণ। সবাই যখন জানলা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে ভয়ে, তখন সেই খর্বদেহী মানুষটি দেখলেন, গাড়ির মধ্যে ছোটো একটি শিশু ও তার বাবা-মা। দম্পতির প্রাণভিক্ষার আবেদন পৌঁছোল না মানুষ ধরার দলের কানে। তারা শিকার করবেই। ততক্ষণে রক্তপিপাসু হিংস্র দাঙ্গাবাজেরা স্পোর্টসফিল্ডের বাইরে ঘিরে ফেলেছে, তৈরি করে ফেলেছে মানব ব্যারিকেড। নেমে এলেন লিটল মাস্টার। রুখে দাঁড়ালেন, ঠিক যেই ভাবে লিলি মার্শাল হ্যাডলি গার্নার টমসনদের বিনা হেলমেটে সামলাতেন, সেই ভাবেই। যেভাবে এক প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে থাকতেন, ভারতেকে জিতিয়ে ফিরতেন, সেই ভাবে একা নামলেন। চক্রব্যুহে ঢুকলেন, ঠিক যেন অভিমন্যু। জীবন বাঁচাতে, মৃত্যুকে আড়াল করে, তিনটি স্ট্যাম্প আটকে দাঁড়ালেন স্ট্যান্স নিয়ে।
মানুষ ধরার দল তখন পেট্রোল আর দেশলাই নিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতার নেশায় চুর। চারিদিকের বাড়িঘরের জানলা বন্ধ, এই নৃশংসতা কেউই দেখবেন না। গাড়ির কাচ সব ভেঙে গিয়েছে ইটবৃষ্টিতে। গাভাসকার বললেন, তোমরা কী করতে চাইছ আমি জানি, যা করতে চাইছ, আমাকে দিয়েই শুরু করো। আমি থাকতে ওদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। তোমরা কী মানুষ! আমায় মারো কত হিম্মত দেখি! মাঠের নায়ক জীবনের নায়ক হয়ে, বরাভয় দিলেন। ওই দম্পতি তখন সুনীলের হাত ধরে কাঁদছেন, সুনীল কোলে তুলে নিলেন শিশুটিকে। তখনও সুনীল কাঁপছেন। তাঁর এমন রুদ্রমূর্তি আগে কেউই দেখেনি, কেউ শোনেনি সেই আগুনে কণ্ঠ।
ধারাবিবরণী দেওয়া চোস্ত ইংরেজি বলা লোকটি সেদিন ব্যাট ছাড়াই ম্যাচ বাঁচিয়ে দিলেন। তিনটি উইকেট নয় তিনটি প্রাণ বাঁচালেন। সেই লড়াইয়ের মাঠে আগুনে বোলিং ছিল না, ছিল আগুনে আক্রমণ। ততক্ষণে একনাথ সোলকার, যজুবেন্দ্র সিং ও অন্যান্য ক্রিকেটারেরা নেমে এসেছেন, কারোর হাতে র্যালকেট, কারোর হাতে ব্যাট, কেউ আবার হকি স্টিক নিয়ে। ভিড় হালকা হয় গিয়েছে, প্রতিবাদে পিছু হাটতে শুরু করেছে মানুষ ধরার দল।
এবারও জিতে গেলেন সুনীল। জীবনের মহারণে রুখে দাঁড়ানোতে সেঞ্চুরি করলেন তিনি। পরে ওই তিনজনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। এইভাবে জীবনের লড়াইয়েরও দাদাগিরি দেখালেন বাইশ গজের নায়ক। আজ ওঁর জন্মদিন। জন্মানোর পরেই বদল হয়ে যাচ্ছিলেন অন্য একটি শিশুর সঙ্গে। ভাগ্যিস মামা মাধব মন্ত্রী দেখে চিনতে পেরেছিলেন ছোট্ট সুনীলকে! না হলে হয়ত একটা গর্ব করার মতো লোকের অভাব হত আমাদের।