তার ১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোনওদিন কার্ড দেখেননি। শুধু লাল কার্ডই নয়, জীবনে কখনও হলুদ কার্ডও দেখেননি। এটা সত্যি যে, সত্তর এবং আশির দশকে ফুটবল মাঠে শারীরিক ট্যাকল করার প্রচলন ছিল এবং ফিফার নিয়ম-কানুনও তত কড়া ছিল না। তারপরও তাঁর মতো তেকাঠি চেনা স্ট্রাইকার একেবারেই কোনো কার্ড না দেখা বড় কৃতিত্ব। তিনি গ্যারি লিনেকার।
আশির দশকে ফুটবল বিশ্বে যে ক'জন স্ট্রাইকার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে লিনেকার অন্যতম। ব্রিটিশ ফুটবলারকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার বলা হয়। আশির দশক ছিল তার কেরিয়ারের সেরা সময়। দেশের হয়ে অসাধারণ সব গোল করে সবার নজর কাড়েন তিনি।
আপাতদৃষ্টিতে যেসব গোল অসম্ভব বলে মনে হয়, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় তাকেই জালে জড়িয়ে দিয়ে আসতেন লিনেকার। কোন 'মুভ' থেকে গোল হতে পারে আর কোনটি থেকে নয়– এটা বিশেষভাবে অনুভব করার ক্ষমতাই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছিল। এরকম খেলোয়াড় যে কোনও দলের বড় সম্পদ হয়। লিনেকারও তাই ছিলেন। তার মতো খেলোয়াড়ের এক একটি গোল যে প্রায় সমশক্তিসম্পন্ন দুই দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়, তা বলাই বাহুল্য।
আর সে কারণে লিনেকার হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যান্ড দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক সদস্য। ক্লিনিক্যাল ফিনিশিংয়ের কারণে বিপক্ষ দলের কাছে ছিলেন এক আতঙ্কের নাম। তার ফুটবল কেরিয়ারে বার্সেলোনা, এভারটন, লিচেস্টার সিটি, টটেনহ্যাম হটস্পারের মতো বিশ্বসেরা ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে মোট ৫৬৭ ম্যাচ খেলেছেন, যাতে তিনি গোল করেছেন ২৮১।
১৯৬০ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের লিচেস্টার শহরে এই প্রতিভাবান স্ট্রাইকারের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ফুটবল ও ক্রিকেটে সমান দক্ষ। অভিজাত পরিবারের ছেলেটি খেলাধূলায় এতটাই মনোযোগী ছিল যে কিছুতেই স্কুলের গন্ডি পেরতে পারছিল না। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধূলায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করে ছেলেটি। তা দেখেই বাবা পাঠিয়ে দিলেন বাড়ির নিকটবর্তী লিচেস্টার সিটির ফুটবল একাডেমিতে। ১৯৭৬ সালে লিচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের যুবদলে নাম লেখানোর আগে লিচেস্টার স্কুল ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।
১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে লিচেস্টার সিটির হয়ে দ্বিতীয় বিভাগের লীগে লিনেকারের ফুটবল কেরিয়ারের সূচনা। প্রথম তিন মরসুমে মোট ৩৭ ম্যাচ খেলে তরুণ লিনেকারের গোলসংখ্যা ছিল ৭। সেসময় তাকে স্টাইকার পজিশনে না খেলিয়ে উইঙ্গার পজিশনে খেলানোয় তেমন একটা গোলের দেখা পাননি। দলেও খুব একটা নিয়মিত ছিলেন না। ১৯৮১-৮২ মৌসুমে ক্লাবের নির্ভরযোগ্য সদস্য হিসেবে নিজের আসন পাকা করেন লিনেকার। ঐ মরসুমে দ্বিতীয় ডিভিশনের লীগে ৩৯ ম্যাচ খেলে ১৭ গোল করেছিলেন। পরের মৌসুমে ৪০ ম্যাচে ২৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার অর্জন করেন এবং লিচেস্টারকে দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জিতে পরের বছরেই প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে লিচেস্টার। ১৯৮৩-৮৪ মরসুমে দলের হয়ে ৩৯ ম্যাচে ২২ গোল করে লিনেকার হন লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরের মরসুমে ২৪ গোল করে হন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। লিচেস্টারের হয়ে সাত বছরে মোট ২১৬ ম্যাচ খেলে ১০৩ গোল করেন লিনেকার। ফলে জাতীয় দলে ঢুকতে এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে।
লিচেস্টার দলের হয়ে তার অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখে ইংল্যান্ডের বড় বড় দলগুলো তাকে দলে নিতে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে লিনেকার যোগ দেন সেসময়ের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এভারটন ক্লাবে। সেই মরসুমে এভারটনের হয়ে ৫২টি ম্যাচ খেলে ৩০ গোল করে দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম বিভাগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন লিনেকার এবং তার সাথে জিতে নেন পিএফএ ও ফুটবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের বর্ষসেরা খেলোয়াড়। ওই মরসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এভারটনের হয়ে লিনেকারের গোলসংখ্যা ছিল ৩৮।
১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সে স্প্যানিশ জায়ান্ট ক্লাব বার্সেলোনা বিরাট অর্থ ব্যয় লিনেকারকে দলে নেয়। বার্সেলোনার হয়ে নিজের প্রথম মরসুমে লিনেকার ছিলেন লা লিগার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৩-২ গোলের জয়ে হ্যাটট্রিকসহ ঐ মৌসুমে তিনি লা লিগায় করেন ২০ গোল। পরের মরসুমে বার্সেলোনার হয়ে জিতে নেন 'কোপা দেল রে' শিরোপা।
১৯৮৯ সালে বার্সেলোনা থেকে ফিরে এসে লিনেকার যোগ দেন ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পারসে ক্লাবে। ১৯৯০-৯১ মরসুমে টটেনহ্যামকে তিনি এফএ কাপ জেতাতে সাহায্য করেন। মরসুমে টটেনহ্যামের হয়ে ১৩৮টি ম্যাচ খেলে ৮০টি গোল দেন। আর তিনটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ইংলিশ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জেতা প্রথম ও একমাত্র ফুটবলারের নাম গ্যারি লিনেকার।
জাতীয় দলের হয়েও গোল করায় কখনো ক্ষান্ত ছিলেন না লিনেকার। যদিও তা দেশকে কোনও শিরোপা এনে দিতে পারেননি। ১৯৮৪ সালে প্রথম জাতীয় দলে খেলার ডাক পান। লিনেকারের গোল করার ক্ষমতা কতখানি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে দেশের হয়ে তার গোলের পরিসংখ্যানটি নিলে। ১৯৮৪ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার প্রথম ম্যাচ থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত ৮০ আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলে গোল করেন ৪৮।
দুর্দান্ত সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার হিসেবে ইংল্যান্ডের ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ দলে স্থান হয় তার। প্রথম বিশ্বকাপেই তার অসাধারণ গোল করার সুবাদে ফুটবল ভক্তদের মাঝে স্থায়ী আসন গেড়ে নেই এই গোল স্কোরার। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন লিনেকার। দুর্দান্ত সাফল্য বলাই বাহুল্য। ইংল্যান্ড সেই বিশ্বকাপে দলগতভাবে তেমন কিছু করতে না পারলেও লিনেকারকে আটকে রাখা যায়নি। ছিয়াশির বিশ্বকাপে মারাদোনার পাশাপাশি লিনেকার ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। মোট ৬টি গোল করে লিনেকার হন সর্বোচ্চ গোলদাতা, জেতেন গোল্ডেন বুট।
১৯৮৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ড এবং লিনেকারের জন্য ছিল হতাশাময়। টুর্নামেন্টে লিনেকার কোনও গোল পাননি এবং ইংল্যান্ডকেও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৯০ এর ইতালির বিশ্বকাপে লিনেকার যেন আবার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এই বিশ্বকাপে করেন চার গোল। গ্রুপ পর্বে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একটি গোল এবং কোয়ার্টার ফাইনালে তার করা দুই গোলের সুবাদে ইংল্যান্ড পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।
সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পর লিনেকারের গোলে সমতায় ফিরে ইংল্যান্ড। তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা টাইব্রেকারে জিতে যায় পশ্চিম জার্মানি। লিনেকার দুই বিশ্বকাপ মিলে ১২ ম্যাচে ১০ গোল করেন।
জাতীয় দলের হয়ে অবসর নেন ১৯৯২ সালে আর ১৯৯৪ সালে সব ধরনের পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন লিনেকার। এই অসমান্য ফুটবলারকে ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ড সরকার 'অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার' খেতাবে ভূষিত করে। ২০০৩ সালে তাকে 'ইংলিশ ফুটবল হল অব ফেম' অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে জনপ্রিয় ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও ধারাভাষ্যকার হিসেবে লিনেকার তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।