এডেনিয়ামের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসটা ভীষণ ভাইটাল। ভাইটাল, কেননা এই মাসে শীত শেষে গরম পড়তে শুরু করে এবং এডেনিয়ামও শীতঘুম সেরে জেগে ওঠে। ফলে, এডেনিয়ামের নতুন চারা বসানো থেকে শুরু করে পুরনো গাছের প্রতিস্থাপন ও ফুল পাবার আগের মুহূর্তের জরুরি পরিচর্যার আবশ্যিক সময় হচ্ছে এই ফেব্রুয়ারি।
এডেনিয়াম পাঁপড়ির বিচারে দু’রকমের হয়—সিঙ্গল পেটাল ও ডাবল পেটাল। এই গাছ বছরে তিন বার ফুল দেয়। সমস্ত পাতা ঝরিয়ে এর শীতঘুম শুরু হয় ডিসেম্বর মাস থেকে। এই সময় কালেভদ্রে শুধু জল ছাড়া আর কিচ্ছু খায় না সে, ফুল দেওয়ার প্রশ্নই থাকে না। এর ঘুম ভাঙে ফেব্রুয়ারির শুরুতে। তারপর উপোষ ভেঙে সে তেড়েফুঁড়ে খেয়ে গায়ের জোর বাড়িয়ে পাতা গজিয়ে ডাল ছেড়ে ফুল দিতে শুরু করে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের শুরু থেকে।
আমরা সকলেই জানি যে, এডেনিয়াম খুব রোদ ভালোবাসে। ভীষণ খরা সহ্য করতে পারে সে। কেননা, এই গাছ মরুভূমির গাছ। একইসঙ্গে গোলাপের মতোই হাজার রঙের সৌন্দর্যময় ভ্যারাইটি রয়েছে এই গাছের, তাই এই গাছকে বাংলায় ‘মরুগোলাপ’ও বলা হয়। এই গাছ ছাদে বা ব্যালকনি বাগানে করতে হলে, এমন জায়গায় টব রাখতে হবে, যেখানে সাত থেকে আট ঘন্টা সরাসরি রোদ আসে। ভালো রোদ না-পেলে এই গাছ ফুল দেবে না। তাই যারা এবার নতুন এডেনিয়াম করবেন, তাঁরা এই বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখবেন।
এডেনিয়াম যারা করেন, শুধু ফুলের জন্য করেন না, এর গাছের সৌন্দর্যও দারুণ। গাছ বলতে এর কাণ্ডের সৌন্দর্য। যাকে বলা হয়, ‘কর্ডেক্স’। সেটা মোটা হয়ে হয়ে ঘটের আকার নেয়, তখন ফুলওয়ালা সমগ্র গাছটি চমৎকার একটি ফুলদানি বলে মনে হয়। সিঙ্গল পেটাল এডেনিয়ামের ডাল মাটিতে পুঁতলেই তা থেকে নতুন একটি গাছ পাওয়া যায়। কিন্তু ডালের গাছের কর্ডেক্স সাধারণত মোটা হয় না। কর্ডেক্স মোটা পেতে হলে আপনাকে বীজের গাছ চাষ করতে হবে। বাজারে বীজের চারা বা বীজের চারায় কলম করে সেটা বিক্রি হয়। সেগুলো বিভিন্ন সাইজের হয়ে থাকে। এবার আপনার পছন্দ অনুযায়ী একদম ছোট চারাও নিতে পারেন অথবা একটু বড়। কিংবা একেবারে তৈরি গাছ।
এডেনিয়ামের টব কেমন হবেঃ
যদি আঙুল-সাইজের চারা আনেন, তাহলে সেটা তিন থেকে চার ইঞ্চি পটে প্রতিস্থাপন করবেন। চারাটি যদি ছোট্ট পট বা পলিব্যাগে থাকে, তাহলে খুব সাবধানে তাকে সেখান থেকে প্রথমে বার করুন। তারপর মাটিশুদ্ধ শেকড়-অংশটা জলে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখুন। মাটি নরম হয়ে গলে গেলে সাবধানে মাটি ধুয়ে মাটি থেকে শেকড়শুদ্ধ গাছটা আলাদা করে ফেলুন। খেয়াল রাখবেন, শেকড়ে যেন আঘাত না-লাগে বা ছেঁড়ে। এবার এক চিমটে ছত্রাকনাশক (সাফ) ও আধ চা-চামচ এপসম সল্ট (সম্ভব হলে এর সঙ্গে দু’ফোঁটা হিউমিক এসিড) মিশিয়ে গাছের শেকড়-অংশটা মিনিট পনেরো ডুবিয়ে রাখুন। তারপর তুলে খোলা বাতাসে চারাটি রেখে দিন।
গাছের কর্ডেক্স মোটা করার জন্য এই গাছ প্রথম থেকেই বনসাই-পদ্ধতিতে চাষ করতে হয়। প্রয়োজনের চেয়ে ছোট টবে চারা বসাতে হয়। অন্য গাছের চারা যেমন প্রথমে আমরা মোটামুটি আট ইঞ্চি টবে প্রতিস্থাপন করি, এক্ষেত্রে কিন্তু তিন থেকে চার ইঞ্চি টবে চারা বসাবো। এই গাছ জমা জল একেবারেই পছন্দ করে না, গোড়া পচে সটান মারা যায়। তাই টবের তলায় বেশ কিছু ফুটো করে দিতে হবে, যাতে জল দেওয়ার পর এক মুহূর্তও তা না-জমে থেকে মাটি ভিজিয়ে নীচ দিয়ে বেরিয়ে যায়। টবের এই ড্রেনেজ সিস্টেম এডেনিয়ামের ছোট-বড় সমস্ত রকম গাছের জন্যই মেন্টেইন করতে হবে। এটা ঠিক রাখলে এবং ডিরেক্ট সানলাইট পেলে বর্ষার টানা বৃষ্টিতেও এ-গাছের ক্ষতি হয় না।
এডেনিয়ামের মাটি কেমন হবেঃ
এডেনিয়ামের জন্য সঠিক খাবার সরবরাহ করবে, কিন্তু জল জমতে দেবে না; এমন মাটি তৈরি করে নিতে হবে। দোআঁশ মাটি এক ভাগ, বালি এক ভাগ, ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর অথবা পাতাপচা সার এক ভাগ এবং বাকি এক ভাগে থাকবে সমান পরিমাণে কাঁকর ও কাঠ কয়লার টুকরো; এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে হাফ চামচ হাড়গুঁড়ো, হাফ চামচ শিং-কুচি, হাফ চামচ নিমখোল, এক চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড ভালো করে মিশিয়ে নিলেই উপযুক্ত মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি ছোট থেকে বড় সমস্ত রকমের এডেনিয়ামের চারা রোপণ ও রি-পটিং করার জন্য উপযুক্ত মাটি। এই মাটি দিয়ে টবের আশিভাগ ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে চারার শেকড়-অংশটা বসিয়ে চারপাশের মাটি ভালো করে চেপে দিন, তারপর পর্যাপ্ত জল ঢেলে দিন। চারদিন গাছশুদ্ধ টবটি ছায়ায় রেখে, পঞ্চমদিন থেকে ফুলসানলাইটে রাখুন।
এডেনিয়ামের খাবারঃ
ছোট্ট চারা বসানোর পর পরবর্তী কুড়ি থেকে পঁচিশদিন খাবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গাছকে নতুন মাটিতে জমিয়ে বসতে এটুকু সময় অন্তত দিন। মাটিতে থাকা খাবার এই সময় সে আরামসে খেতে পারবে। এরপর যখন খাবার দেওয়া শুরু করবেন, তখনও ঐ কুড়ি-পঁচিশ দিনের গ্যাপ রাখবেন। ছোট চারাকে এই সময় টব প্রতি এক চামচ বাদাম খোল ভেজানো জল বা দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ বা জিরোঃবাহান্নঃচৌত্রিশ এক লিটার জলে দু’গ্রাম মিশিয়ে দেবেন। আর দেবেন ফাঙ্গিসাইড একই পরিমাণে। এই খাবারগুলো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেবেন।
বড় গাছের জন্য মাসে একবার টব প্রতি বাদাম খোল এক চামচ এক লিটার জলে ভিজিয়ে দেবেন। সিঙ্গল সুপার ফসফেট টব প্রতি এক চা-চামচ দেবেন। পনেরো দিন অন্তর সরষের খোল ভেজানো জল পাতলা করে দিয়ে যাবেন। এর সঙ্গে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ বা জিরোঃবাহান্নঃচৌত্রিশ এনপিকে এক লিটার জলে দু’গ্রাম টব প্রতি দিয়ে যাবেন। সঙ্গে দেবেন ফাঙ্গিসাইড। ব্যস, আর কিচ্ছু লাগবে না।
এবার বলি জলের কথা। গাছে জল দেবেন মাটি শুকিয়ে আসছে দেখলে তবেই। ভেজা মাটিতে জল দেবেন না, মাটি খটখটে হয়ে শুকিয়েও যেতে দেবেন না। এটা ছোট-বড় সব ধরণের গাছের জন্যই সমানভাবে মেন্টেইন করবেন।
এডেনিয়ামের ফুল আসার সময় পরিচর্যাঃ
আগেই বলেছি, শীতকাল বাদ দিলে এডেনিয়াম বছরে তিনবার ফুল দেয় দু’মাস করে করে। মাঝে একমাস করে সে বিশ্রাম নেয়। বছরের প্রথম ফুল দেওয়া শুরু হয় মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ। ছোট গাছে এ-বছর ফুল নেবেন না। ফুল নিলে গাছটার বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। তাই গাছটাকে একটা বছর হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বাড়তে দিন, তাকে একটা শেপ নিতে দিন; কলি এলেও এ-বছর তা ভেঙে দিয়ে ফুল নেবেন পরের বছর।
বড় গাছের ক্ষেত্রে যদি কোন গাছে সময়ে ফুল না-আসে, তাহলে তার টবে পনেরো দিন অন্তর পটাশ দেওয়া শুরু করুন এক চা-চামচ পরিমাণে। গাছের গোড়া থেকে দূরে টবের চারপাশের ভেজা মাটিতে সেটা ছড়িয়ে দেবেন। এর পরিবর্তে পটাশ-কেন্দ্রিক এনপিকে শূন্যঃশুন্যঃপঞ্চাশ এক লিটার জলে দু’গ্রাম পরিমাণে মিশিয়ে গাছে দেবেন। অল্পদিনেই ফুল আসতে শুরু করবে।
এডেনিয়ামের প্রতিস্থাপন ও কর্ডেক্স মোটা করার উপায়ঃ
এডেনিয়ামের প্রতিস্থাপনের আদর্শ সময় এই ফেব্রুয়ারি। যে-সব গাছ টব আঁটছে না এমন অবস্থা হয়েছে, সেগুলো এক সাইজ বড় টবে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এই প্রতিস্থাপনের পদ্ধতি ও মাটি তৈরি চারা বসানোর ক্ষেত্রে যেটা বলা হয়েছে, সেভাবেই করতে হবে।
যদি কোন গাছের শেকড় ছাঁটাই করে কোন কারণে প্রতিস্থাপন করতে হয়, তাহলে গাছের বয়স কমপক্ষে দু’বছর হতে হবে। এক্ষেত্রে মূল শিকড় ঠিক রেখে বাড়তি শেকড় ছেঁটে ভালো করে ফাঙ্গিসাইড লাগিয়ে আগের পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করতে হবে। অবশ্য শেকড় পচতে শুরু করলে তা বয়স না-হলেও ছাঁটতেই হয়, নইলে পুরো গাছ মরে যাবে। এবার শেকড় যে পচছে, সেটা বুঝব কী করে? গাছের শেকড় পচতে শুরু করলে গাছের শাখার ডগা শুকোতে শুরু করে। এমন অবস্থা দেখলে গাছ তুলে পচা ও আক্রান্ত অংশ ছেঁটে এবং চেঁছে ফেলে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দু’একদিন বাতাসযুক্ত আলোছায়াঘেরা স্থানে রেখে তাকে নতুন মাটিতে বসিয়ে দিতে হবে।
যদি কোন গাছের কর্ডেক্স মোটা করতে হয়, তাহলে অপ্রয়োজনীয় শেকড় ছেঁটে ভালো করে শেকড়ের যতটা অংশ ধবধবে সাদা, তাতে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে পনেরো থেকে কুড়ি দিন গাছটি এমন জায়গায় টাঙিয়ে দিতে হবে, যেখানে বেশ ভালোরকম বাতাস চলাচল করে এবং ইন্ডিরেক্ট সানলাইট আসে। এতে কী হবে, গাছ এই পনেরো থেকে কুড়ি দিন বাইরে থেকে কোন খাবারই পাবে না। সে করবে কী, তার কর্ডেক্সে জমা খাবার খেয়ে বেঁচে থাকবে। এবার পনেরো-কুড়ি দিন পর যখন তাকে আগের পদ্ধতিতে মাটি তৈরি করে তাকে প্রতিস্থাপন করা হবে, অমনি সে প্রচুর খাবার স্টোর করতে শুরু করবে কর্ডেক্সে, যাতে আগের মতো অবস্থায় পড়লে তাকে খাবারের কষ্টে ভুগতে না-হয়। আর এই অতিরিক্ত খাবার স্টোর করার প্রবণতা থেকেই কর্ডেক্সে স্থান বাড়াতে নিজেই কর্ডেক্স মোটা করবে গাছ।
এডেনিয়ামের প্রুনিং
এডেনিয়ামের প্রুনিং-এর আদর্শ সময় হল এই ফেব্রুয়ারি মাস। বর্ষায় একেবারেই করবেন না। প্রুনিং করার জন্য গাছটির দেড় থেকে দু’বছর বয়স হলে ভালো হয়। প্রুনিং করলে এই গাছ বেশ ঝোপালো হয়, কাজেই গাছের শাখা বেশি হলে ফুলও বেশি পাওয়া যায়।
যে গাছ প্রতিস্থাপন করবেন, তা আগে প্রুনিং না-করে, করবেন প্রতিস্থাপনের দিন পনেরো পর। এতে গাছের ধকল কম হবে, প্রচুর শাখা হবে এবং অঢেল ফুলও হবে। ছত্রাকের সংক্রমণ এড়াতে প্রুনিং করার পর কাটা জায়গায় অবশ্যই ফাঙ্গিসাইড লাগাবেন।
এডেনিয়ামে পোকামাকড়ের আক্রমণঃ
এডেনিয়ামে মিলিবাগ, লাল মাকড় ও ল্যাদা পোকার খুব প্রকোপ দেখা যায়। এক লিটার জলে দু’এমএল শ্যাম্পু মিশিয়ে স্প্রে করলে মিলিবাগ চলে যাবে। আর বাকি দুটোর উপযুক্ত ওষুধ কীটনাশকের দোকান থেকে এনে প্রথম অবস্থাতেই স্প্রে করে দেবেন।
এডেনিয়ামের বীজের চারা তৈরিঃ
এডিনিয়াম গাছে শিঙের মতো লম্বা সরু ফল হয়। ফল পাকার আগে সুতো পেঁচিয়ে বেঁধে দেবেন, নইলে একবার ফল পেকে তা শিমূল ফলের মতো ফেটে যাবে এবং বীজও হাওয়ায় উড়ে যাবে। বীজ আর পাবেন না। যাই হোক, বীজ সংগ্রহ করে আলো ও বাতাস আসে এমন জায়গায় শুধু বালি বা বালি ও কোকোপিট একসঙ্গে মিশিয়ে বেড তৈরি করবেন। এবার তার ওপর বীজ ছড়িয়ে হাফ ইঞ্চি লেয়ারে ঢাকা দিয়ে জল দিলেই দিন পাঁচেকের মধ্যে চারার জন্ম হবে। চারার বয়স একমাস হলেই তা আরামসে অন্য টবে বসানো যাবে, বাড়ানো যাবে বাগানের এডেনিয়ামের সংখ্যা।