ব্যালকনি বা ছাদবাগানে শীতে প্রচুর জবা ফুল ফোটানোর সহজ উপায়

জবার মাটিতে লাগানো গাছ আর টবের গাছের প্রকৃতি কোন ঋতুতেই এক থাকে না। তবে সবচেয়ে ফারাকটা চোখে পড়ে এই শীতকালে এসে। দেখবেন, মাটিতে হয়তো একই জাতের গাছে এই সময় ফুল ফুটছে, কিন্তু টবের গাছে ফুটছে না। আসলে, টবের গাছে সবসময়ই কিছু বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। সেই পরিচর্যার ধাপগুলো জানা থাকলে প্রায় মাটির মতোই এই শীতেও বিভিন্ন জাতের জবা গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। আপনার সাধের ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে এই শীতে জবা গাছের পরিচর্যা যে-ভাবে করলে গাছ ভালো থাকবে, যে-ভাবে সহজে ফুল পাবেন; সেগুলো সূত্রাকারে সাজিয়ে দিচ্ছিঃ

এক. প্রথমেই বলি যে, জবা গাছ বেশ চড়া রোদ খুব ভালোবাসে। সারা বছরই তাকে সাত থেকে আট ঘন্টা বেশ ভালো রোদ আসে, এমন জায়গায় রাখলে তা থেকে সন্তোষজনক হারে ফুল পাওয়া যায়। শীতে রোদ যেহেতু বেশ নরম হয়, তাই সারাদিনের এই রোদ বা দিনের অনেকখানি রোদ যাতে আপনার জবা গাছ পেতে পারে, এমন জায়গায় টব রাখুন।

দুই. শীতে টব ফুল-সানলাইটে রাখলেই যে আপনি ভালো ফুল পাবেন, তারও কোন মানে নেই। কেননা, সব ধরণের জবা গাছ এই সময় চড়া রোদে রাখলেই ফুল দেয় না। তাই গাছ বুঝে এই রোদে রাখার শ্রমটা আপনাকে করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন গাছ এই সময় ফুল-সানলাইটে রাখবেন, কোনটা রাখার দরকার নেই? দেখুন, প্রজাতিগত দিক থেকে জবা গাছ মূলত দু’ধরণের হয়। দেশি প্রজাতি ও হাইব্রিড প্রজাতির। এই হাইব্রিড প্রজাতির গাছগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই সারা বছর কমবেশি ফুল দেয়। কিন্তু কিছু কিছু দেশি জবা শীতকালে ফুল দেয় না। এটা তাদের বিশ্রাম বা ঘুমের সময়। এবার কী দেখে বুঝবেন, শীতে কোন গাছ বিশ্রামে যাচ্ছে? দেখবেন, যে গাছে শীতের আগে পাতা হলুদ হয়ে ঝরে যাচ্ছে বা সঠিক খাবার দেওয়া সত্বেও গাছ তার বৃদ্ধি বন্ধ রেখেছে বা প্রচুর রোদ ও সঠিক পরিচর্যা পাওয়া সত্বেও কম কুঁড়ি এলেও তা ফুটছে না এবং ফোটার আগেই ঝরে পড়ছে।–এগুলোই শীতঘুমে যাবার আগে ও ঘুমে মগ্ন জবাগাছের লক্ষণ। যে-সব গাছে এই লক্ষণগুলো দেখতে পাবেন, তাদের টানাটানি করে কোন লাভ নেই। এই সব লক্ষণ যে-সব গাছে দেখা যাচ্ছে না, তা দেশি হোক বা হাইব্রিড, তাদের ফুল-সানলাইটে নিয়ে আসুন এবং ব্যালান্সড খাবার দিন; অবশ্যই ফুল পাবেন।

তিন. যে-সব জবা গাছ শীতঘুমে চলে গেছে, তাদের খাবার দেবার দরকার নেই। কারণ, এই সময় বেঁচে থাকার জন্য জল, অল্প রোদ ও বাতাস ছাড়া আর কোন কিছু তারা গ্রহণ করতে চায় না। ফলে, এই সময় খাবার দিলে তা অহেতুক নষ্ট হবে। কাজেই, এই সব ঘুমন্ত জবা গাছকে এই ভরা শীতে শুধু জল ছাড়া আর-কোন খাবার দেবেন না। গরম পড়তে শুরু করলে এরা খাবার খেতে শুরু করবে, অনেকদিন অভুক্ত থাকার পর খাবার খাবে, তাই তাকে এই সময় সঠিক সুষম খাবার দিতে হবে। হঠাৎ করে প্রচুর খাবার না-দিয়ে শীত একেবারে কমে এলেই একটু একটু করে খাবার দেওয়া চালু করে দিতে হবে। সাধারণভাবে প্রতিটি টবের জন্য এক চামচ হাড়গুঁড়ো (ডাস্ট), এক চামচ শিং-কুচি, এক চামচ নিম খোল, এক চা-চামচ লাল পটাশ, আধ চা-চামচ ফসফেট গুঁড়ো একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে কুড়ি দিন অন্তর দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু এক্ষেত্রে দশদিন অন্তর হাফমাত্রায় খাবার দিতে শুরু করুন। গরম পড়লেই ফুলকোর্স শুরু করুন এবং সপ্তাহে পাতলা করে খোলপচা জল দিতে থাকুন। সরষের খোল হলে মিনিমাম তিনদিন পচাবেন, আর বাদাম খোল হলে একদিন। যে-গাছ শীতে ঘুমোয়, তারা বছরের বাকি সময় ভরপুর ফুল দেয়। তাই কখনই খাবারের কমতি হলে চলবে না। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাবার দিয়ে যেতে হবে। জবা গাছ লাল পটাশ খুব ভালোবাসে, তাই প্রতিবার মিশ্র খাবার দেবার সময় পটাশ অবশ্যই যোগ করবেন। তাছাড়া পটাশ গাছে ফুল আনতে খুব সাহায্য করে।

চার. যে-সব জবা গাছ শীতঘুমে যায়নি, তাদের এই সময় ফুল-সানলাইটে আনার পর যথাযথ খাবার দিতে হবে ও পরিচর্যা করতে হবে। জৈব পদ্ধতিতে প্রতি সাতদিন অন্তর কমপক্ষে তিনদিনের পচানো সরষের খোলের জল পাতলা করে দিয়ে যান। কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন অন্তর এক মুঠো হাড়গুঁড়ো, এক মুঠো শিং-কুচি, এক মুঠো নিম খোল, এক মুঠো পাতাপচা সার, এক মুঠো ভার্মি কম্পোস্ট একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে এই পরিমাণে প্রতি টবে দিয়ে যান। কমপক্ষে পাঁচদিন কলার খোসা পচিয়ে, সেই জলের সঙ্গে আরও জল মিশিয়ে সাতদিন অন্তর টবে দিতে থাকুন। সি-উইড দানা হলে আধ চামচ টব প্রতি এবং লিকুইড হলে এক মগ জলে দু’এমএল মিশিয়ে টবে দিতে থাকুন, মাসে একবার। রাসায়নিক পদ্ধতিতে, ব্যালান্সড এনপিকে অর্থাৎ উনিশঃউনিশঃউনিশ বা তেরঃশূন্য শূন্যঃ পঁয়তাল্লিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি প্রভৃতি আট ইঞ্চি টবের জন্য আধ চা-চামচ, দশ ইঞ্চি টবের জন্য এক চা-চামচ, বারো ইঞ্চি টবের জন্য দেড় চা-চামচ করে প্রয়োগ করতে থাকুন। প্রতি দশদিন অন্তর টব প্রতি আধ চা-চামচ লাল পটাশ দেবেন। মাসে দু’বার এপসম সল্ট এক চা-চামচ এক লিটার জলে গুলে গাছে ও মাটিতে স্প্রে করে দেবেন। যে-কোন খাবার প্রয়োগের দুই থেকে তিনদিন পর মিরাকুলান বা যে-কোন পিজিআর এক লিটার জলে দু’এমএল মিশিয়ে গাছে হালকা করে স্প্রে করে দেবেন, মাসে দু’বার।

পাঁচ. জবা গাছে মেপে জল দিতে হয়। মাটি শুকোলে জল দেবেন, ভেজা থাকলে জল দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

ছয়. সমস্ত খাবার দিয়ে, দারুণ রোদে রেখে, পরিমিত জল দিয়েও যদি দেখেন কুঁড়ি আসছে, কিন্তু ফোটার আগেই হলুদ হয়ে ঝরে যাচ্ছে, তাহলে অনুখাদ্য স্প্রে করুন। দু’গ্রাম গুঁড়ো অনুখাদ্য এক লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করুন পনেরো দিন অন্তর। অথবা, বোরন ওই একই পরিমাণে স্প্রে করুন মাসে দু’বার।

সাত. জবা গাছ কখনই শীতকালে প্রুনিং করবেন না বা রি-পটিং করবেন না। সে যে জাতেরই হোক না কেন। জবা গাছের প্রুনিং ও রি-পটিং-এর আদর্শ সময় ফেব্রুয়ারি-মার্চ। এছাড়াও অক্টোবর মাস নাগাদও এটা করা যায়। বছরে দু’বার। যে-সব জবা গরমের শুরু থেকে শীতের আগে অব্দি ফুল দেবে তাদের প্রুনিং করবেন ফেব্রুয়ারি-মার্চে। আর যে-সব জবা শীতে ফুল দেয়, তাদের প্রুনিং করবেন অক্টবরে। আর যে সব জাতের জবা সারা বছরই ফুল দেয় তাদের এই দুটো সময়ের কোন একটাতে করলেই হবে। আসলে এক্ষেত্রে যখন দেখবেন ফুল কমে এসেছে এবং গাছ বেয়াড়া রকমের বেড়ে উঠেছে; তখনই প্রুনিং কবেন। প্রুনিং-এর সময়ই প্রয়োজন হলে গাছের রি-পটিংও করে নেবেন, এতে গাছকে বার বার ধকল বা ট্রেস সহ্য করতে হয় না, একেবারেই পুরো কাজটা হয়ে যায়। প্রুনিং করার পর গাছের কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইড লাগাতে ভুলবেন না। রি-পটিং করলে গাছকে সবসময় এক সাইজ বড় টবে বসাবেন। আগে আট ইঞ্চিতে থাকলে, এবার বসাবেন দশ ইঞ্চিতে। পুরনো মাটি ও শেকড় ছেঁটে ফেলবেন। এঁটেল মাটি, বালি ও এক বছরের পুরনো গোবর বা ভার্মি কম্পোস্ট বা পাতাপচা সার সমান পরিমাণে মিশিয়ে মাটি তৈরি করবেন। এর সঙ্গে এক মুঠো নিম খোল, এক মুঠো হাড়গুঁড়ো, এক চামচ পটাশ, এক চামচ ফসফেট, এক চামচ এপসম সল্ট, আধ চামচ ফাঙ্গিসাইড ভালো করে মিশিয়ে নেবেন। তারপর টবের ড্রেনেজ ঠিক রেখে এই মাটি দিয়ে চেপে চেপে গাছটি বসিয়ে ভালো করে জল দিয়ে চারদিন ছায়ায় রেখে পাঁচদিনের দিন রোদে দেবেন।

আট. গাছ প্রুনিং ও রি-পটিং-এর পর দিনকুড়ি আর খাবার দেবার দরকার নেই। নতুন পাতা ও ডাল গজিয়ে উঠতে উঠতে ওই মাটি তৈরির সময় সঙ্গে মেশানো খাবারই খেতে থাকবে গাছ। কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন পর থেকে আগের পদ্ধতিতে নিয়মিত খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে।

নয়. জবা গাছে সারাবছরই মিলিবাগের আক্রমণ ঘটে। ঘরোয়া পদ্ধতিতে এক এমএল শ্যাম্পু বা আধ চা-চামচ সাবানগুঁড়ো এক লিটার জলে পর পর দু’দিন সকালে স্প্রে করলেই এই পোকা মরে যায়। এছাড়া ইমিডাক্লোরোপিড গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করলেও এই পোকা দমন করা যায়। আর একটি লার্ভাজাতীয় পোকা জবা গাছের পাতা মুড়িয়ে খেয়ে গাছের বারোটা বাজিয়ে দেয়। এই পোকাগুলো দমন করার জন্য ক্লোরপিরিফস গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করবেন। আসলে, এই দুটো কীটনাশক প্রতি দশদিন অন্তর নিয়মিত প্রয়োগ করে গেলে জবা গাছে কোন পোকার আক্রমণ হবে না, গাছের ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকবে, ফুলও ফুটবে তার অবাধ ও অপার সৌন্দর্য নিয়ে।।...   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...