আমাদের ছাদ বা ব্যালকনি বাগান আমরা নানারকম আকারের, ডিজাইনের টব ও পট দিয়ে সাজাতে ভালোবাসি। আজকাল ফাইবার ও প্লাস্টিকের এত সুন্দর সুন্দর হ্যাঙ্গিং পট আর টব পাওয়া যায় যে, কিছুতেই লোভ সামলানো যায় না। চিনামাটির টব ও পটের সৌন্দর্যের তো তুলনাই নেই। চিনামাটি বা সিরামিকসের টব বা পটের দাম অনেক। তাতে আমার মতো সাধারণ বাগানির অনেকগুলো মাটির টব হয়ে যায়; সেই সঙ্গে কিছু নতুন গাছও হয়ে যায়। যদিও ইনডোর প্ল্যান্ট বা ঘরের ভেতর সাজানোর জন্য গাছ করতে হলে সিরামিকসের পট-ই সবচেয়ে ভালো; তবে পাশাপাশি এটাও বলতে হয় যে, সাজাতে জানলে আর রুচিবোধ থাকলে প্লাস্টিক, মাটি, সিমেন্ট—যে ধরণের পটেই গাছ করুন-না-কেন, বাগান বা বাড়ির অন্দর সুন্দর হয়ে উঠতে বাধ্য।
সাধারণভাবে ছাদ বা ব্যালকনি বাগান করতে আমরা মোটামুটি প্লাস্টিক, মাটি ও সিমেন্টের টব ব্যবহার করে থাকি। এই সব টবের সাইজ যত বড় হয়, দামও হয় তত বেশি। প্লাস্টিকের টব ছাদবাগানে বছর দুয়েক ভালো চলে, এক একটি আট বা দশ ইঞ্চি টবের দাম পড়ে যায় কমবেশি একশো টাকা। সিমেন্টের টব আট থেকে দশ ইঞ্চি সাইজের এক-একটির দাম পড়ে বাজার-বিশেষে দেড়শ থেকে দুশো। তবে অনেকদিন ভালো থাকে। আমার খানকতক আছে, পনের বছর পেরিয়ে গেছে, আরও পনের বছর মনে হয় দিব্যি পেরিয়ে যাবে। মাটির টব বাজার-বিশেষে ওই আট থেকে দশ ইঞ্চি সাইজের এক-একটির দাম পড়ে প্রায় চল্লিশ থেকে আশি টাকা করে। মাটির টবে দামের এই রকমফেরের ভেতরে একটি কথা আছে, তা হচ্ছে দেখতে একই রকম মনে হলেও সব মাটির টব ভালো ভাবে পোড়ানো নয়, ভালো মাটি দিয়ে বানানো নয়, ফলে সেগুলো টেঁকেও না বেশিদিন। তো, সেই খারাপ কোয়ালিটির টবের দাম কমই হয়। আবার বেশি দাম দিলেই যে সবসময় ভালো জিনিস পাওয়া যায়, এমনটাও নয়। বেশি দাম নিয়ে খারাপ টব গছিয়ে দেওয়ার মতো বিক্রেতার অভাব নেই। তবে বিশ্বস্ত দোকানদারের কাছ থেকে কেনাকাটা করলে ব্যাপারটা আলাদা। যাই হোক, ভালো ও টেঁকসই মাটির টব চেনার যে খান দুয়েক টিপস আছে; সেগুলো মাথায় রাখলে ঠকবার সম্ভাবনা কম থাকে। যথাঃ
মাটির টব পোড়ানোর আগে অনেক সময়ই কুমোর এক ধরণের হলদেটে মাটিগোলা জল ন্যাতা দিয়ে টবের গায়ে বুলিয়ে শুকিয়ে নেন। এই প্রলেপ দেওয়ার পর পোড়ালে টবটা পুড়ে এক্কবারে টকটকে লাল রঙের হয়ে যায়। কিন্তু আপনি এই রঙে ভুলবেন না। ভালো করে পরখ করে তবেই টব কিনবেন। ভালো মাটির তৈরি ও ভালো করে পোড়ানো টব একই সাইজের অন্য টবের তুলনায় ওজনে হালকা হয়। কেনার আগে টবটা তুলে বাঁ হাতের তালুর ওপর তার তলাটা বসিয়ে পাঁচ আঙুলে ভালো করে চেপে ধরুন, তারপর অন্য হাতের আঙুল দিয়ে টবের কানায় টুসকি দিন, যদি ‘টং’ করে তীক্ষ্ণ শব্দ হয়, তবেই বুঝবেন জিনিস ভালো, নইলে নয়। ভালো মাটির টব হেসেখেলে কমপক্ষে দশটা বছর অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়।
গাছ করতে জানলে সিমেন্ট, প্লাস্টিক বা মাটি—যে-কোন ধরণের টবেই করা যায়। তবে মাটির টব বেশিরভাগ বাগানিই প্রায়োরিটি দেন। তারও যথেষ্ট কারণ আছে। কলসির জল যে বৈজ্ঞানিক কারণে ঠাণ্ডা থাকে, সেই একই কারণে নিয়মিত ও প্রয়োজনমতো গাছে জল দিলে মাটির টবের মাটি ও গাছের শেকড় গরমকালে তো বটেই, অন্যান্য সময়ও বেশ ঠাণ্ডা থাকে। এটা গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকার অন্যতম কারণ।
আবার মাটির টবের মুশকিল হচ্ছে যে, আঘাত পেলে সহজেই ভেঙে যায়। তাছাড়া গাছে নিয়মিত রাসায়নিক সার দিলে টবে নোনাও ধরে যায়, নোনাধরা বাড়ির দেওয়ালের মতো পাঁপড়ি ছাড়তে ছাড়তে, মাটি ঝরতে ঝরতে অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যায়। ভালো করে না-পোড়ানো ও খারাপ মাটির তৈরি টবে এই সমস্যা তাড়াতাড়ি শুরু হয়। মাটির টবে নোনা ধরে গেলে টোটকা হিসেবে তেঁতুলের কাঁই বেশ পুরু করে মাঝে মাঝে টবের গায়ে লাগিয়ে দিলে উপকার পাওয়া যায়। অনেকেই টবের গায়ের নোনা ছাড়াতে বা ঝকঝকে করতে রেড অক্সাইড রঙ সিমেন্টের সঙ্গে গুলে বা ফেবিকল দিয়ে গুলে টবের গায়ে লাগিয়ে দেন। পেইন্টও করেন অনেকে। এতে সমস্যার সাময়িক সমাধান হয় ঠিকই, কিন্তু তাতে টবের গায়ের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র বন্ধ হয়ে টবের ভেতরের মাটি ও গাছের শেকড় ঠাণ্ডা রাখার বৈজ্ঞানিক উপায়টি আর কাজ করে না।
তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বছর দুয়েক হল প্লাস্টিক, সিমেন্ট বা মাটি প্রভৃতির তৈরি টবের ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি। আমি জোর দিয়েছি পলিপ্যাকে গাছ তৈরির ওপর। তাতে আমি দেখেছি যে, বড় ফলের গাছ ছাড়া যে-কোন ধরণের ফুল ও সবজি অত্যন্ত সফলভাবে চাষ করা সম্ভব পলিপ্যাকে।
দেখুন, পলিথিনের ক্যারিবাগ ও বিভিন্ন সাইজের প্যাকেট আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, তার বিকল্প কোনকিছুই হয়ে উঠছে না। একবার ব্যবহারের পর তা রাস্তাঘাটে, বাড়ির আশপাশে, নর্দমার স্তূপে আমরা ফেলে দিই। ফেলা ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না, কাজে লাগানোর সচরাচর ইচ্ছেও থাকে না। তার কারণ এগুলো খুব সস্তা ও সহজলভ্য। ফলে এগুলো আমাদের পরিবেশে যথেচ্ছ ছড়িয়ে দূষণের প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। কীভাবে এই দূষণ নিয়ত বাড়ছে, তার পরিসংখ্যান ও বহর আমরা প্রত্যেকেই জানি। এখন আমরা যদি আমাদের বাড়ির পলিপ্যাকেটগুলো না-ফেলে ছাদ বা ব্যালকনিবাগানের গাছ লাগানোর কাজে ব্যবহার করি, তাহলে দূষণের পেছনে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অবদান কিছুটা অন্তত কমে। শুধু তাই নয়, এতে করে টব কেনার খরচ এক্কেবারে বেঁচে যায়। সেই বাঁচানো টাকা দিয়ে আমরা অনায়াসেই অনেকগুলো নতুন ফুলের গাছ কিনে ফেলতে পারি।
ভাবছেন, পলিব্যাগে গাছ করলে সাধের ছাদ বা ব্যালকনিবাগান বিশ্রী লাগবে না তো? একেবারেই না। একবার করেই দেখুন না! আসলে, ফুল গাছ যে আধারেই করুন না কেন, তার সৌন্দর্যে কোন কৃপণতা থাকে না। বাগানের সিংহভাগ সৌন্দর্য সেই-ই তার ফুল-পাতা-লতা দিয়ে ফুটিয়ে তোলে।
একশ গ্রাম চায়ের প্যাকেট থেকে পাঁচ-দশ কেজি আটার প্যাকেট; জামাকাপড়ের প্যাকেট থেকে বাচ্চাদের ডায়পারের প্যাকেট; অনলাইন শপিং-এর প্যাকেট; মুদি বা মিষ্টির দোকান থেকে পাওয়া বিভিন্ন সাইজের ক্যারিব্যাগ—সব জমিয়ে রেখে দেবেন ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে গাছ লাগানোর জন্য। কোন ধরণের পলিব্যাগে কী গাছ লাগাবেন, আমি এর পরের লেখাগুলোতে ঠিক আপনাদের বলে দেব।
পলিব্যাগ বা ক্যারিব্যাগে গাছ লাগানোর পদ্ধতিঃ
পলিব্যাগ বা ক্যারিব্যাগে গাছ করার জন্য মাটি ও সারের সঙ্গে একস্ট্রা একটা পেরেক বা একটা স্টিলের শক্ত কাঁটাচামচ শুধু লাগবে। মাটি, ভার্মি কম্পোস্ট, বালি প্রভৃতি মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নেওয়ার পর তা দিয়ে পলিব্যাগের পঁচাত্তর ভাগ ভর্তি করে নিতে হবে। টবে যেমন আমরা তলায় খোলামকুচি, পাথর, বালি প্রভৃতি দিয়ে জলনিকাশির ব্যবস্থা রাখি, পলিব্যাগে সে-সবের প্রয়োজন নেই। পরমাণমতো মাটি দেওয়ার পর শুধু পেরেক বা কাঁটা চামচ দিয়ে পলিব্যাগের নীচের দুটো কোনায় চার-পাঁচটা ফুটো করে দিতে হবে এবং দুটো পাশে একদম নীচের দিকে চার-পাঁচটা ফুটো করে দিতে হবে। (পেরেকে বেশ কয়েকটা ফুটো আলাদা করে করতে হয়, কাঁটাচামচে সেটা একবারেই করা যায়। কাঁটাচামচের এটুকুই সুবিধে)। এই ফুটোগুলো দিয়েই অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাবে, কোথাও এতটুকু জল জমে থাকবে না। যাই হোক, তৈরি-মাটি ভরার পর পলিব্যাগের ওপরের দিকে যে পঁচিশ ভাগ জায়গা খালি আছে, সেই দিকে এবার আমাদের মন দিতে হবে। পলিব্যাগের ওপরের দিকের পলিথিন ফোল্ড করে করে নীচের দিকে দশ শতাংশ নামিয়ে দিতে হবে। এতে ওপরের দিকে একটা গোল বিড়ের মতো অংশ তৈরি হবে। এটা ওপরের ওই ফাঁকা অংশের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে যেমন সাহায্য যেমন করবে, তেমনি চট করে পলিব্যাগটা ছিঁড়েও যাবে না; সেই সঙ্গে গাছ লাগানোর পর গোড়ায় জল দিলে পলিব্যাগের ওপরের অংশটা নেতিয়ে গিয়ে জলটা ফেলে দেবে না।
প্যাকেট রেডি হয়ে গেলে আর কী, তাতে ঠিক মধ্যিখানে গাছ লাগিয়ে গোড়ায় জল দিয়ে ছায়ায় তিন দিন রেখে গাছশুদ্ধ ব্যাগটি রোদে নামিয়ে দিন। তারপর নিয়মিত জল দিতে থাকুন, খাবার দিতে থাকুন আর পরিচর্যা বজায় রাখুন। শুধু গাছ নিড়ানোর সময় বা মাটি আলগা করার সময় সাবধানে করবেন, যাতে পলিব্যাগ ফুটো না-হয়ে যায়। পলিব্যাগ সরানোর সময় সর্বদা তলার অংশে হাত দিয়ে চেপে ধরে তুলে সরাবেন। টেনে তুলবেন না বা টানাটানি করে সরাবেন না, ছিঁড়ে যাবে।
বাচ্চার ডায়পারের প্যাকেটগুলো বেশ শক্তপোক্ত হয়, যেগুলোর ভেতরে চৌষট্টি বা চুয়াত্তরটার মতো ডায়পার থাকে; সেগুলোতে আমি বিভিন্ন ধরণের জবা ও গন্ধরাজ লাগিয়েছি। অনলাইন শপিং-এ প্রোডাক্ট মুড়িয়ে যে প্যাকেটগুলো আসে; তাতে মিলি, গোলাপ, বিভিন্ন ধরণের পাতাবাহার, চন্দ্রমল্লিকা, দোপাটি, দুপুরে, গাঁদা, ভিনকা ও বিভিন্ন ধরণের স্নেকপ্ল্যান্ট প্রভৃতি লাগিয়েছি। আরবিয়ান খেজুরের প্যাকেটগুলো মারাত্মক শক্ত, ওগুলোতে ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট করেছি। মুদি দোকানের তিন কেজি ও পাঁচ কেজির গোলগলা ও হাতলওয়ালা প্যাকেটে বিভিন্ন ধরণের শাক, বেগুন, লঙ্কা, কপি আমি সারাবছরই চাষ করে থাকি। আর পাঁচশো, এক কেজির হাতলওয়ালা ক্যারিব্যাগে গত দু’বছর ধরে আমি ছাদবাগানে পেঁয়াজ চাষ করি। আর একশ গ্রাম ও পঞ্চাশ গ্রামের প্যাকেটগুলো বীজ থেকে চারা তৈরির কাজে ব্যবহার করি।
পলিব্যাগগুলো মান-অনুযায়ী ছ’মাস থেকে দেড় বছর অব্দি আরামসে চলে যায়। তারপর ফুটোফাটা হলে তাপ্পি মারার জন্য চওড়া ব্রাউন টেপ কিনে রেখেছি, সে-সব জোড়াতালি দিয়ে আরও ছ’মাস কি এক বছর আয়ু বাড়িয়ে নিই। একটা পঁচিশ থেকে তিরিশ টাকা দামের টেপ দিয়ে অনেকগুলো পলিব্যাগ সারাই করা যায়। পলিব্যাগগুলো আমি তখনই বাতিল করি, যখন ঝুরো ঝুরো হয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। তখন গাছগুলোকে নতুন পাওয়া কোন পলিব্যাগে স্থাপন করি।
অনেকের ধারণা ছাদবাগানে গ্রীষ্মকালে পলিব্যাগে চাষ করা যায় না। প্রখর তাপে ছাদের গরম গাছগুলোর শেকড় পুড়িয়ে দেয়, গাছগুলোকে মেরে ফেলে। বিশ্বাস করুন, আমি যেখানে থাকি, সেখানে গ্রীষ্মকালে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা ওঠে। তাতে পলিব্যাগে ছাদে ফুল ও সবজি দুইই চাষ করেছি, একটাও গাছ মরেনি। এক্ষেত্রে সঠিক সময়ে জল দিয়েছি, আর সকালে বা বিকেলে গাছগুলোকে প্রতিদিন স্নান করিয়ে দিয়েছি পাইপের জল দিয়ে। ব্যস।
তাহলে আর কী, আপনারাও পলিব্যাগে বিকল্প পদ্ধতিতে ব্যালকনি বা ছাদবাগানে চাষ করুন। সাশ্রয়ের পাশাপাশি প্লাস্টিক-দূষণ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিন সমস্ত চরাচরে...