আমরা জানি যে, অধিকাংশ ফুল গাছ থেকেই ভালো ফুল পেতে গেলে ছয় থেকে আট ঘন্টা বেশ ভালো রোদের প্রয়োজন হয়। এবার সবার ছাদ বা ব্যালকনিতে তো আর এতক্ষণ রোদ আসে না, অনেকেরই ফ্ল্যাট বা বাড়ির ব্যালকনিতে মাত্রই এক ঘন্টার জন্য রোদ আসে, তাও হয়তো সকালের বা শেষ বিকেলের হালকা রোদ। তাহলে যাঁদের ব্যালকনি বা ছাদে এইটুকু সময়ের জন্য রোদ আসে, তাঁরা কি সাধ হলেও ফুলের বাগান করতে পারবেন না? নিশ্চয় পারবেন। তবে তাঁরা সব ধরণের ফুলের বাগান করতে পারবেন না, যে-সব ফুল অল্প রোদ পেলেই ফোটে, বেছে বেছে সেই সব ফুলের গাছ লাগিয়ে আপন সাধের বাগান তাঁরা সাজিয়ে তুলতে পারবেন। অল্প রোদে হয় এমন ফুলের মধ্যে অপূর্ব সুন্দর ফুল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসাধারণ সুগন্ধে মাতাল করে দেওয়ার মতো ফুলও। তা, সেই সব ফুলগাছ কোনগুলি? তাদের পরিচর্যাই বা কীরকম? আসুন, এবার এ-ব্যাপারেই আলোচনা করা যাকঃ
বেগনিয়াঃ বেগনিয়ার ফুল তো অপূর্ব সুন্দর বটেই, এমনকি এর পাতাও অনন্যসুন্দর। ফলে, এই ফুলের চাষ করলে একইসঙ্গে ফুলগাছ ও পাতাবাহার দুয়েরই অভাব পূরণ হয়ে যায়। মূলত সাদা, গোলাপি এবং লাল রঙের বেগনিয়াই আমাদের এখানে প্রচলিত। সিঙ্গল পেটাল ও থোকা দুই রকমের ফুল হয়। ফুলগুলো বারোমাস ফোটে। সেগুলো এমনই নিটোল চকচকে জেল্লাদার যে, যেন মনে হয় প্লাস্টিকের তৈরি। আর পাতাগুলোও মনে হয় যেন ভেলভেটের তৈরি। এই ফুল প্রায় কোন পরিচর্যা ছাড়াই চাষ করা যায়। এর পাতা ও ফুলের এমনি বিস্ময়কর বাহার যে, শুধুমাত্র এই ফুল দিয়েই সাধের ছাদবাগান সাজিয়ে নেওয়া যায়।
বেগনিয়া খুব নরম প্রকৃতির গাছ। একে টানা বৃষ্টির জল থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। দু’একদিন বৃষ্টি হলে অসুবিধে নেই; কিন্তু টানা বৃষ্টি হলে বৃষ্টির জল যেখানে পড়ে না, সেখানে গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। জল কখনোই বেশি দেবেন না। এই গাছে জল বেশি দেওয়া হয়ে গেলেই শেকড় পচে, কাণ্ড গলে মারা যায়; নইলে দিব্যি থাকে। তাই টবে জল জমতে দেওয়া যাবে না। টবের মাটি শুকোলে তবেই জল দেবেন। এমন পরিমাণে জল দেবেন, যাতে শুধুমাত্র মাটি ভেজে। ভাসিয়ে জল দেবার কোন দরকার নেই। গাছের উপরে জল দেবেন না। গাছের ডাল খুব নরম, পাতাও খুব নরম। জলের ঝাপটায় সেগুলো ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া জল দীর্ঘসময় ধরে যদি পাতার ওপর জমে থাকে, তাহলে পাতায় পচন ধরিয়ে দিতে পারে। পাতার ওপর ধুলো জমলে সেগুলো আস্তে করে ধুয়ে দেবেন, মাসে একবার, তার বেশি না।
বেগনিয়া যেহেতু খুব বেশি জল পছন্দ করে না, তাই এমনভাবে টবের মাটি তৈরি করবেন ও টবের ড্রেনেজ মেন্টেইন করবেন, যাতে টবে একেবারেই না জল জমে। এর জন্য এঁটেল মাটি ও বালি সমান সমান নিয়ে তার সঙ্গে এক ভাগেরও কম ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে মাটি তৈরি করবেন। আট থেকে দশ ইঞ্চির টবে এই গাছ বসাবেন। ধীরে ধীরে বেশ ঝোপালো হয় এই গাছ। এই গাছের কাণ্ড ও ডাল সবই বেশ নরম, তাই গাছের আকার বাড়লে টবে একটা কঞ্চি বা ওই জাতীয় সুন্দর খুঁটি দিয়ে তার সঙ্গে গাছটিকে হালকা করে বেঁধে দেবেন; দিব্য লাগবে দেখতে। এই গাছকে ঘন ঘন খাবার দেবার দরকার পড়ে না। পনেরো থেকে কুড়ি দিন অন্তর সরষের খোল কমপক্ষে তিনদিন পচিয়ে পাতলা করে সেই জল গাছের গোড়ায় দিয়ে গেলেই এই গাছ ফুল দিতে থাকে। সরষের খোল পচানো দুর্গন্ধ বা অন্যান্য কারণে যাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাঁরা দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ বা উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি পাঁচ থেকে ছয় দানা এক লিটার জলে ভালো করে গুলে, সেই জল পাঁচটা করে টবে দেবেন। সরষের খোল ও রাসায়নিক সার যারা ব্যবহার করতে চান না, তাঁরা মাসে একবার ভার্মি কম্পোস্ট দু’মুঠো করে টবে দেবেন, তাহলেও হবে। কম্পোস্ট যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে জল ধরে রাখে, তাই এক্ষেত্রে গাছে জল দেবার সময়, ভালো করে মাটি শুকিয়েছে কিনা পরীক্ষা করে তবেই জল দেবেন।
বেগনিয়ার একটি গাছ থেকে অনায়াসেই একাধিক চারা তৈরি করে নেওয়া যায়। এই গাছের ডাল ভেঙে পুঁতে দিলে অল্পদিনেই তা নতুন একটি গাছে পরিণত হয়। এই গাছে পোকামাকড় বা রোগ অসুখের কোন সমস্যা নেই। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। সুতরাং, দেখতেই পাচ্ছেন, প্রায় রোদ ছাড়াই, যত্ন ছাড়াই বেগনিয়া দিয়ে সাধের বাগান খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেওয়া যায়।
হাসনুহানাঃ হাসনুহানা রাত্তিরে সমস্ত বাগান অপূর্ব সুগন্ধে ভরিয়ে রাখে, এ তো আমরা সকলেই জানি। সেই সঙ্গে আমরা অনেকেই শুনে থাকি যে, হাসনুহানার গন্ধে নাকি সাপ আসে! আসলে, এটা একটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই না। তাই নিশ্চিন্তে আপনার সাধের বাগানের টবে হাসনুহানার চারা বসান। কেননা, অতি অল্পরোদেই এই ফুলের চাষ সম্ভব।
হাসনুহানার চারা কিনতে গিয়ে আমরা একটা সমস্যার সম্মুখীন হই আমরা, সেটা এই গাছ সম্পর্কে ঠিকভাবে না-জানার জন্য। আসলে, এই গাছ দু’ধরনের হয়। একটা বিদেশি, একটা দিশি। পাতা একই রকম। তবে বিদেশিটা লতানে; কিন্তু দিশিটার ডাল তুলনায় শক্ত ও খাড়া থাকে। আপনি হাসনুহানা চারা কিনতে গিয়ে বিদেশিটা কিনবেন, দিশিটা নয়। কারণ বিদেশিটারই ফুল রাত্রে ফোটে, অপূর্ব গন্ধ ছড়ায় এবং দিনের বেলা ফুলগুলো বুজে যায়। কিন্তু দিশিটার ফুল দিনের বেলাতেও ফুটে থাকে এবং ফুল গন্ধ প্রায় ছড়ায়ই না বলতে গেলে। দিশি-বিদিশি না-চেনার কারণেই অনেকে হাসনুহানা কিনতে গিয়ে ঠকে যান। শেষমেশ ফুলে গন্ধ না-পেয়ে হতাশ হন।
বেগনিয়ার জন্য যেভাবে দোআঁশ মাটি তৈরির কথা বলেছি, সেভাবেই মাটি তৈরি করবেন। সঙ্গে এক মুঠো নিমখোল ও হাড়গুঁড়ো দেবেন। আর দেবেন এক চা-চামচ ছত্রাকনাশক। এই মাটি ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে দশ ইঞ্চির টবে ভরে হাসনুহানার চারা বসিয়ে দেবেন। ব্যস।
টবের মাটি শুকোলে গাছে জল দেবেন। গাছের গোড়ায় জল জমতে দেবেন না। মাঝে মাঝে ছত্রাকনাশক স্প্রে করে গাছ ও মাটি ভিজিয়ে দেবেন। কেননা, যেখানে অল্প রোদ মাত্র আসে, সেখানকার গাছে ছত্রাকের আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। গাছের খাবার দেবেন নিয়ম করে। দশ দিন অন্তর পাতলা সরষের খোল পচানো জল। বাদাম খোল একদিন পচিয়ে পাতলা করে দিতে পারেন। মাসে একবার অনুখাদ্য স্প্রে করবেন এক লিটার জলে দু’গ্রাম বা পঁচিশ ফোঁটা মিশিয়ে। রাসায়নিক সারে এই গাছ করতে চাইলে ব্যালান্সড এনপিকে উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি বা দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ আট থেকে দশ দানা প্রতি টবের ধার ঘেঁষে মাটিতে চারপাশে পুঁতে দেবেন। আধ চা-চামচ পটাশ গোড়া থেকে দূরে মাটিতে দেবেন মাসে একবার। চাইলে মাসে একবার এক বছরের পুরনো গোবর বা কম্পোস্ট এক মুঠো করে প্রতি টবে দিতে পারেন।
হাসনুহানার রোগবালাই তেমন নেই। ডাল কেটে পুঁতে দিলেই এই গাছের নতুন চারা তৈরি হয়ে যায়। ফলে একটি গাছ থেকে সহজেই একাধিক গাছ আপনি এভাবে নিজেই তৈরি করে ফেলতে পারবেন। এই গাছ থেকে শীতকালে কোন ফুল পাওয়া যায় না। তাই সুন্দরী অথচ গন্ধহীন বেগনিয়ার সঙ্গে এই সুগন্ধী ফুলের চাষ করে আপনার সাধের বাগানে সৌন্দর্য ও সুগন্ধের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন।
সন্ধ্যামণিঃ সন্ধ্যামণি একটি অপূর্ব সুন্দর ফুল। কোন যত্নছাড়াই এই গাছ থেকে ফুল পাওয়া যায়। সাদা, লাল, গোলাপি এবং হলুদ রঙের ফুল হয় সন্ধ্যামণির। আপনার যদি যে-কোন দুটো রঙ থাকে, তাহলে এই গাছ আপনাকে চমকের পর চমক দেবে, নিজে নিজেই কখনো মাঝে মাঝে কখনো-বা ধারাবাহিকভাবে মিক্সকালারের ফুল ফুটিয়ে।
সন্ধ্যায় এই ফুল ফোটে, তখন থেকে পরের দিন সকালে রোদ চড়া হওয়ার আগে অব্দি এই ফুল থাকে। ফুলে মৃদু গন্ধ আছে। এর বিভিন্ন রঙের চারা লাগাতে পারলে এ-একাই বাগানের সৌন্দর্য বদলে দিতে পারে। গাছের গোড়ায় জল না-জমে এমন দোআঁশ মাটি তৈরি করে দশ ইঞ্চি টবে এই গাছ লাগাবেন। কারণ, এই গাছ বেশ ঝাঁকড়া হয়। এর ডাল খুব শক্ত নয়, খুটখাট ভেঙে যায় একটু চাপ পড়লে, তাই গাছ বেড়ে উঠলে খুঁটি দেবেন। সন্ধ্যামণি লক্ষ্মী গাছ। শুধু জল দিয়ে গেলেও ফুল দেয়। তবু সাতদিন অন্তর সরষের খোল পচা জল বা আগের ব্যলান্সড এনপিকে আগের বলা পরিমাণে পেলে ও তার সাথে মাসে একবার কম্পোস্ট পেলে সন্ধ্যামণি আপনাকে সারা বছর অসংখ্য ফুলে ফুলে ভরিয়ে রাখবে। এই গাছের রোগবালাই নেই, কীটনাশকের খরচাও নেই। ফুল শুকিয়ে গেলে কালো কালো গোলমরিচের মতো বীজ হয়। তা থেকে নতুন গাছ তৈরি করে নিতে পারেন। এভাবেই এই তিন ধরণের গাছ অল্প রোদে, অল্প খরচে, অল্প পরিচর্যায় সাজিয়ে রাখতে পারেন সাধের বাগান।।...