গড়বেতার শ্রী শ্রী সর্বমঙ্গলা মন্দির, প্রাচীন বঙ্গের তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান

অবিভক্ত মেদিনীপুরের ঐতিহাসিক জনপদ হল গড়বেতা। অধুনা তা পশ্চিম মেদিনীপুরে। গড়বেতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মহাভারত। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, পাণ্ডবরা জতুগৃহ থেকে প্রাণে বেঁচে এই অঞ্চলে ছদ্মবেশে কিছুদিন বাস করেছিলেন। কথিত আছে, তাদের একচক্রনগর এখন এক্যেড়া গ্রাম। তাঁরা যে গ্রামে ভিক্ষা করতেন, তা এখন ভিখনগর নামে পরিচিত। এখান থেকেই তারা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় গিয়ে লক্ষ্যভেদ করে রাজকন্যাকে লাভ করেছিলেন। পাণ্ডবরা একচক্রনগরীতে থাকাকালীন মহাবলী ভীম বকরাক্ষসকে যে স্থানে হত্যা করেছিলেন সেই স্থান হল গড়বেতার গণগণির খুলা। গড়বেতার বগড়ী একটি প্রাচীন জনপদ। এই অঞ্চলের পৌরাণিক নাম ছিল বক দ্বীপ। কথিত আছে, মহাভারত খ্যাত বক এই দ্বীপে বাস করত। তার নামানুসারে এই দ্বীপের নাম ছিল বক দ্বীপ। পরে হয় বক ডিহী এবং পরবর্তীকালে বগড়ী। বগড়ীর রাজধানী হল গড়বেতা।

মল্ল রাজবংশের অষ্টম রাজা শূরমল্ল ৭৭৫-৭৯৫ সাল নাগাদ মেদিনীপুরের বগড়ী রাজ্য অধিকার করেন। চোদ্দ শতকের শেষে বা পনেরো শতকের গোড়ায় গজপতি সিংহ এই এলাকা জয় করে বগড়ী রাজ্য নবপ্রতিষ্ঠা করেন। অনেকেই মনে করেন, এখানকার বেত গাছ থেকেই গড়বেতা নামের জন্ম। কুমার গুপ্তের রাজত্বকালে বেত্রবর্মা এখানকার রাজা ছিলেন। তাই নাকি জায়গার নাম গড়বেতা। ১৭৭৯ সালের মানচিত্রে বেতা নামটি পাওয়া যায়। রাজারা গড় নির্মাণের পর এখানকার নাম হয় গড়বেতা। গড়বেতা তথা বগড়ীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সর্বমঙ্গলা। আদপে তিনি মা দুর্গার আরেক রূপ। দেবী সর্বমঙ্গলা সিদ্ধিপ্রদায়িনী। তিনি ভক্তদের মনস্কামনা পূরণ করেন। সে কারণেই দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এই মন্দিরে আসেন।

গড়বেতার অধীষ্টাত্রী দেবী শ্রী শ্রী সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরের বয়স ১০০০ বছরেরও বেশি। সাধারণত দেবদেবীর মন্দিরের মুখ হয় দক্ষিণে। তবে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের মুখ উত্তর দিকে। এটিই ভারতের একমাত্র উত্তরমুখী মন্দির। সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পাশাপাশি এখানে রয়েছে ১২টি শিবের মন্দির। মন্দিরটি পীর দেউল স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। এক সময় মন্দিরটি মাকড়া পাথর নির্মিত ছিল। তিনবার মন্দির তৈরি হয়েছে, ফলে তিনটি আলাদা আলাদা সময় ও স্থাপত্য রীতির ছাপ এই মন্দিরে স্পষ্ট।

উজ্জ্বয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য এবং তাল-বেতাল জড়িয়ে রয়েছে এই মন্দিরে। একবার এক যোগী সাধক এই বগড়ির জঙ্গলে এসেছিলেন। তিনিই নাকি মন্ত্রবলে সর্বমঙ্গলার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবীর মাহাত্ম্যের কথা রাজা বিক্রমাদিত্যের কাছে পৌঁছলে তিনি গড়বেতায় আসেন। শবসাধনা করে দেবীকে খুশি করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, মহারাজ বিক্রমাদিত্য সর্বমঙ্গলা মায়ের সামনে তপস্যায় বসেন। তাঁর সাধনায় মুগ্ধ হয়ে দেবী তাঁকে অলৌকিক ক্ষমতা দেন। ক্ষমতা পেয়েছেন কিনা তা পরীক্ষা করতে বিক্রমাদিত্য তাল বেতালকে নির্দেশ দেন মন্দিরের মুখ দক্ষিণ থেকে উত্তরে করতে। সঙ্গে সঙ্গে তাল বেতাল মন্দিরের মুখ পরিবর্তন করে। এও জনশ্রুতি রয়েছে তাল বেতাল থেকেই নাকি এলাকার নাম হয়েছে গড়বেতা। তবে মন্দির উত্তরমুখী হওয়ার কারণ অবশ্য আলাদা, যেখান তন্ত্রসাধনা হয়, পঞ্চমুণ্ডির আসন থাকে সেখানে মন্দির উত্তরমুখী বানানো হয়। যাতে সূর্যের আলো চৌকাঠ না পেরোতে পারে। তবে এ কথা সত্য এই মন্দির ছিল তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান। এখানে বলিপ্রথার প্রচলন ছিল, আজও তার প্রমাণ রয়েছে। মন্দিরের চত্বরেই রয়েছে হাঁড়িকাঠ। প্রায় আটশো বছর আগে এখানে নরবলি দেওয়ার চল ছিল।

মন্দির নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তি শোনা যায়, গড়বেতা এককালে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং উপজাতদের আবাসস্থল। শিকারই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। শিকার করতে যাওয়ার আগে তারা বনদেবীর পুজো করত। এই বনদেবীই কালে কালে বগড়ীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা হয়ে ওঠে। মনে করা হয়, আইচ বংশের প্রথম রাজা গজপতি সিংহ মন্দির নির্মাণ করে দেবী সর্বমঙ্গলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। মেদিনীপুরে বারবার বর্গী আক্রমণ হয়েছে। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলায় বর্গি আক্রমণের কাহিনী। বর্গিরা এই মন্দিরে বারেবারে হানা দিয়েছে। মন্দিরের কষ্টিপাথরের মূর্তি নষ্ট করেছে। পরবর্তীতে রাজা গজপতি সিংহ মন্দির তৈরি করে নতুন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকেই দেবী এখানে পূজিতা হন দুর্গারূপে। প্রতি বছর পঞ্চমী তিথিতে দেবীর অঙ্গরাগ হয়। মোম, পারদ, গালা, সিঁদুর দিয়ে দেবীর মুখমণ্ডল তৈরি করা হয়।

দেবী সর্বমঙ্গলা খুবই জাগ্রত। দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তিটি কালো প্রস্তর নির্মিত, খোদাই করা রয়েছে দেবী সিংহবাহিনী। তিনি দশভুজা। দেবীর মুখমণ্ডল লালরঙের। মূল খোদাইয়ের উপর গালা দিয়ে নির্মিত মুখাবয়ব। নাকে বড় নোলক। দীর্ঘ চোখ। পাশে রয়েছে অন্নপূর্ণা ও ভৈরবীর খোদাই করা মূর্তি। দেবীমূর্তির পাশেই পঞ্চমুণ্ডি আসন। দেবীর নিত্য পুজো হয়। এখানকার দুর্গা পুজো মেদিনীপুরের অন্যতম প্রাচীন পুজো। বিশেষ করে দুর্গা পুজোর নবমীর দিন সর্বমঙ্গলা মন্দিরে উপচে পড়ে ভিড়। দেবীকে এখানে নিত্য ভোগ দেওয়া হয়। বিশেষ দিনে বিশেষ ভোগ নিবেদন করার রেওয়াজ রয়েছে। মকর সংক্রান্তিতে পিঠে নিবেদন করা হয়। সর্বমঙ্গলা মন্দিরে গেলে আজও দেখতে পাওয়া যায় পঞ্চমুণ্ডির আসন। কথিত আছে আগে এখানে নাকি নরবলি হত। ছাগ, মহিষ বলি চলত। মল্লরাজ দুর্জন মল্ল বলিদান প্রথা বন্ধ করে দেন। তারপর থেকে বৈষ্ণব মতে পুজো আরম্ভ হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...