ঘিয়ে রঙা শাড়ি। চোখে কাজল। কপাল জোড়া লাল টিপ। রাস্তা দিয়ে রানীর মতো হেঁটে আসছে এক নারী। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। শাড়িতে সোনার কারুকাজ।
একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে রাস্তা দিয়ে সে হেঁটে আসছে সে রাস্তা শহরের আর পাঁচটা সাধারণ রাস্তা থেকে অনেকটাই আলাদা। দেহপসারিনীদের এলাকা।
উদ্ধত ওই নারী আদতে ‘রানী’ই। কামাথিপুরার রানী। ‘ম্যাডাম অব কামাথিপুরা’।
একেবারে অন্য চেহারায় স্ক্রিন জুড়ে আলিয়া। চেনা চেহারা থেকে বেরিয়ে এক অন্য ভূমিকায়।
লকডাউনের জেরে প্রায় মরা সিনেমা বাজারে যেন হঠাৎ বড় ঢেউ। সঞ্জয় লীলা বনশালির পরিচালিত ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’র ট্রেলার সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শেয়ারের বন্যা।
কিন্তু কে এই গাঙ্গুবাই?
ট্রেলারের সংলাপ টানছে মানুষকে। পুরো ট্রেলার দেখে নিতে বাধ্য করছে।
পতিতাপল্লীর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতেও ঘুরে দাঁড়াবার এক সাহসের নাম গাঙ্গুবাই। তাঁরই নাম ভূমিকায় আলিয়া।
গাঙ্গু হরজীবনদাস কাঠিয়াওয়াড়ি। ষোড়শী এক কন্যা। গুজরাটের কাথিয়াওয়াড় জেলায় বাস।
সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসত সেই মেয়ে। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় বুঁদ। মাথার ভিতর রঙ ছড়াচ্ছে আশা পারেখ, হেমা মালিনী। মনের মধ্যে বসন্তের গুনগুন ।
বাবা নামকরা অ্যাডভোকেট। বাড়িতে আসত বাবার হিসাবরক্ষক। একদিন চোখে লেগে গেল তাকে। কাঁচা প্রেমের টানে ভেসে গেল সে।
একেবারে বিয়ের পিঁড়িতে। গাঙ্গু ঘর ছাড়া হল।
সদ্য বিয়ে করা স্বামীর সঙ্গে একেবারে আরব সাগরের তীরে। মুম্বই। আশা-হেমার শহরে পা রেখে ভুলে গেল ফেলে আসা ঘর পরিবারের কথা।
কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগল না। হাতের চুড়ির রঙ পুরনো হওয়ার আগেই বিক্রি হয়ে গেল লাল বাতি এলাকার অন্ধকারে। যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল সেই প্রেমিক-স্বামীই তাকে তুলে দিল অন্যের হাতে। মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে।
এক সপ্তাহ টানা কেঁদে গিয়েছিল ষোল বছরের ঘরছাড়া সেই কিশোরী। বাড়ি, প্রেম, প্রেমিক আর পতিতালয় এই চারে অঙ্ক মেলানোর চেষ্টা। কিন্তু সব বৃথা। ফিরে যাওয়ার সব রাস্তা হারিয়ে গিয়েছে কামাথিপুরার কোঠি পথে।
সে পথেই চলল গাঙ্গুর জীবন। থেমে থাকল না...
বাণিজ্য নগরীর রইস শেঠরা কামেথিপুরার এই মেয়ের জন্য পাগল। দাদা-ভাই- কোম্পানির লোক কে নয়! সেভাবেই দেখা করিম লালার সঙ্গে।
মাফিয়া করিম লালা’র এক সাগরেদের হাতে পড়ে গাঙ্গু। ধর্ষণের শিকার হতে হয় তাকে।
মুম্বইয়ের অপরাধ জগতের রোজনামচায় গাঙ্গুর কিস্যা খুব অভাবনীয় কিছু নয়। কেউ আশ্চর্যও হয় না এসব গল্পে। পরিনতিটাও জানা।, কিন্তু কোন কাহিনীর মোড় কখন কীভাবে যে ঘুরে যায় অনেক সময় তা লেখক নিজেও জানতে পারে না। গাঙ্গুবাই-এর গল্পটাও যেন তেমনই।
লিখেছেন হুসেন জায়দি। তাঁর ‘মাফিয়া কুইনস অফ মুম্বই’ বইটিতে।
পতিতালয়ের জীবনে বিকিয়ে যেতে হয় গুজরাট থেকে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই আসা মেয়েটিকে। তবে সঙ্গী ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি আর সাহস।
জীবনের শুরুতে করিম লালার দলের এক সাগরেদের শিকার হতে হয় তাকে। করিম লালার কাছে তার বিচার চেয়েছিল ধর্ষিতা গাঙ্গু। করিম লালা ‘রাখী বোন’র মর্যাদা দেয় তাকে।
সেই সূত্রেই প্রভূত ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির অধিকারীনী। কামতাপুর এলাকায় গাঙ্গুবাইয়ের রাজ শুরু হয়।
ধীরে ধীরে মুম্বই নগরীর সাড়াজাগানো মাফিয়া কুইন।
গাঙ্গুবাইকে নিয়ে আরব সাগরের তীরে মিথ কম নয়। লালবাতি অঞ্চলের মেয়েদের অধিকার আর দাবী নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন গাঙ্গু। সেই দাবীকে দেশের শীর্ষ ক্ষমতার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। দেখা করেছিলেন জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে। পথ সহজ ছিল না। কিন্তু তাঁর চেষ্টা আর লড়াইও বিচ্যুতিহীন।