‘সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার’ –এই কথাটি কিন্তু বহুল প্রচলিত। কথাটির অর্থ হল- যে পুণ্য তীর্থযাত্রীরা অন্যান্য সব তীর্থ ভ্রমণ করে অর্জন থাকেন, তার চেয়ে অধিক পুণ্য লাভ করা যায় যায় গঙ্গাসাগরে একবার তীর্থযাত্রা করলে।
কলকাতা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাগর দ্বীপ। হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। এই অঞ্চলকে পুরাণে কখনো দক্ষিণ সাগর কখনও বা কপিল সাগর বলা হয়েছে। সাংখ্য দর্শনের মুখ্য প্রবক্তা মহর্ষি কপিল-এর আশ্রম ছিল এই গঙ্গাসাগরে। সেই আশ্রম সময়ের সাথে সাথে জীর্ণ হয়ে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এখানে বর্তমানে কপিলমুনির নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনন্ত কাল ধরে সমুদ্রের অতল জলরাশির দিকে যেন চেয়ে আছেন মহর্ষি কপিল। প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির দিন এখানে গঙ্গা এবং সাগরের সঙ্গমে বহু হিন্দু পুণ্যার্থী পুণ্য অর্জনের আশায় স্নান করতে আসেন। বাঙালি ছাড়াও বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা অবাঙালি পুণ্যার্থীদের প্রচুর ভিড় হয়। হিন্দুদের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান।
ছোটবড় ৫১টি দ্বীপের সমাহারে ৫৮০ বর্গ কিমি জুড়ে সাগরদ্বীপ। বঙ্গোপসাগর উপকূলে এই সাগরদ্বীপের প্রাচীন নাম ছিল শ্বেতদীপ। এই দ্বীপভূমির দক্ষিণে গঙ্গা নদী বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই মোহনার নাম তাই গঙ্গাসাগর। গঙ্গা বা ভাগীরথীর মর্ত্যে আসা ও সগর রাজার পুত্রদের জীবনদানের লোকগাথাকে ঘিরে এই তীর্থস্থানের গড়ে ওঠা। কপিল মুনির প্রাচীন আশ্রমটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা কপিল মুনির মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে মকর সংক্রান্তির পুণ্য তিথিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় জমে এই সঙ্গমে।
প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি তিথিতে সাগর নদীর সঙ্গমস্থলে স্নানযোগে পুণ্যস্নান করেন লক্ষাধিক পুণ্যলোভী ভক্ত মানুষ এবং এই উৎসব উপলক্ষ্যে বসে মেলা। গঙ্গা নদী ও বঙ্গোপসাগরের পবিত্র মিলনস্থলে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব ও মেলা। কুম্ভমেলার পরে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা হল এই গঙ্গাসাগর মেলা। কিন্তু কুম্ভমেলার সঙ্গে গঙ্গাসাগর মেলার পার্থক্য আছে।
গঙ্গাসাগর কিন্তু মূল ভূখণ্ডের বাইরে এক দ্বীপ। এই দ্বীপভূমির এক দিকে ভাগীরথী, অন্য দিকে মুড়িগঙ্গা, আর এক দিকে বড়তলা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ভারতবর্ষের জলবেষ্টিত দ্বীপে একটিই সর্বভারতীয় ধর্মীয় মেলা হয়, তার নাম গঙ্গাসাগর মেলা। আরও একটা পার্থক্য আছে। কুম্ভমেলায় দু’-তিনটি শাহি স্নানের লগ্ন থাকে কিন্তু গঙ্গাসাগরে তা নয়। মাত্র এক দিন, পৌষসংক্রান্তিতেই এত মানুষের সাগরে অবগাহন। এক দিনে সাগরদ্বীপে এত লোকের জমায়েত, এমনটা সারা দেশে আর কোথাও হয় না।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী কপিল মুনি হলেন স্বয়ং নারায়নের একটি রূপ। একবার কপিলমুনির ক্রোধের আগুনে সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র ভস্মীভূত হন এবং তাদের আত্মা নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। সগর রাজার পৌত্র ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে আবাহন করে নিয়ে এসে সাগরপুত্রদের ভস্মাবশেষ ধুয়ে ফেলেন এবং তাঁদের আত্মাকে মুক্ত করে দেন। ভগীরথ দ্বারা আবাহন করা হয়েছিল বলে গঙ্গার আরেক নাম ভাগীরথী। মহাভারতের বনপর্বে তীর্থযাত্রা অংশেও গঙ্গাসাগর তীর্থের উল্লেখ রয়েছে।
পালবংশের রাজা দেবপালের একটি লিপিতে গঙ্গাসাগর- সঙ্গমে তাঁর এক ধর্মানুষ্ঠান করার কথা উল্লিখিত হয়েছে। এই পুণ্যস্নানকে কেন্দ্র করে ভক্তদের সমাগম প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। যুগ যুগ ধরে প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মকরসংক্রান্তি বা পৌষ-সংক্রান্তির পুণ্যতিথিতে লক্ষ লক্ষ পুণ্যকামী হিন্দু ধর্মের মানুষের সমাগম ঘটে এখানে।
তারা বিশ্বাস করেন যে এই দিনে গঙ্গাসাগরে স্নান করলে ১০০টি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য লাভ হয়। মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর স্নানের পিছনে যে পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে তা এরকম যে, শিবের জটা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা যেদিন ঋষি কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছেছিলেন, সেই দিনটি ছিল মকর সংক্রান্তির দিন। এই দিনেই মা গঙ্গা কপিল মুনির অভিশাপে মৃত্যুবরণ করা রাজা সগরের ৬০ হাজার পুত্রকে মোক্ষ দান করে সাগরে মিলিত হয়েছিলেন। গঙ্গাসাগর মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো হিমালয়ের সাধুরা। বহুদূর থেকে এসে তীব্র শীত উপেক্ষা করে কেবল ছাইভস্ম গায়ে মেখে অনাবৃত শরীরে তারা তাদের ধর্মাচরণ করে থাকেন।
এখানে উল্লেখ্য যে এই উৎসব কিন্তু প্রায় দুশো বছরের পুরনো। সাগরতটের এই মেলার জনসমাগম সম্পর্কে ১৮৩৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘'ভারতবর্ষের অতি দূর দেশ অর্থাৎ লাহোর, দিল্লি ও বোম্বাই হইতে যে বহুতর যাত্রী সমাগত হইয়াছিল তৎসংখ্যা ৫ লক্ষের ন্যূন নহে। বাণিজ্যকারি সওদাগর ও ক্ষুদ্র দোকানদারেরা যে ভূরি ভূরি বিক্রয়দ্রব্য আনয়ন করিয়াছিল, তাহা লক্ষ টাকারো অধিক হইবে।"...
সেই মেলা এখনো বসে। অস্থায়ী দোকানে নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রেতারা। পাওয়া যায় অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, হাঁড়ি, কড়াই, প্লাস্টিকের খেলনা, কড়ি ও ঝিনুকের মালা, ছোট খাটো খেলনা, খাবার জিনিস। ঘি আর কর্পূরে বাতি তৈরি করে সাগরে ভাসিয়ে দেন বিহারী মহিলারা। পৌষ সংক্রান্তির ভোর বেলায় প্রবল ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে কনকনে ঠাণ্ডা সাগরে স্নান করে পুজো দিতে যান কপিল মুনির মন্দিরে। রঙিন আলোয় সাজানো হয় কপিল মুনির মন্দির। সরকারের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মেলায় নানারকমের সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে। জাতপাতের বিভেদ ভুলে, সমস্ত সঙ্কীর্ণতা দূরে ঠেলে ঐক্যবদ্ধ এক টুকরো ভারতেরই যেন সন্ধান মেলে এই সাগরতীর্থে। এখানেই যেন সেই পুণ্য তীর্থ যেখানে "নমি নর-দেবতারে"...
আজকের লেখা শেষ করব বিশ্বকবির সেই অবিস্মরণীয় কবিতার পংক্তি দিয়ে–
হে মোর চিত্ত,পুণ্য তীর্থে
জাগো রে ধীরে--
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে
নমি নর-দেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে
বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যান-গম্ভীর এই যে ভূধর,
নদীজপমালাধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।..