এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনবোধ ও কাজের সমীকরণ ব্যাখা করতে গিয়ে ওঁনার ছিল এই মতামত।গনেশ পাইন। যাঁর শিল্পে বাংলার চিত্র বানী পেয়েছিল নতুন মর্যাদা ।১৯৩৭ এ জন্ম অবিভক্ত বাংলায়। বড় হয়েছেন উত্তাল ভারতের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। সেসময় মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন শিল্পী- যে গল্প আজও মুখে মুখে ফেরে।১৯৪৬ এর দাঙ্গায় ঘর ছাড়া হয়ে থাকছিলেন একটি হাসপাতালে। নিজের শহরের ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে চেয়ে যখন বেরোলেন, ধাক্কা খেলেন একটি লাশের স্তূপের সঙ্গে; যার একদম উপরেই ছিল একজন নগ্ন নারী। বুকে ক্ষত এবং গলায় জ্বলজ্বল করছে সোনার একটি লকেট।
সেই দৃশ্যই হয়তো সুনিশ্চিত করেছিল শিল্পীর আগামী উদ্যেশ্য ও জীবন শৈলী।ছেলেবেলায় ঠাকুমা-র কাছে রূপকথা ও মহাভারতের গল্পের নিয়মিত শ্রোতা।সেই কল্পনাই শিল্পী হিসাবে তাঁর দেখার চোখ কে মেলে ধরেছিল। যাঁর মতে একজন শিল্পীর সমস্ত কল্পনার সঞ্চয়স্থল, সেই না দেখতে পাওয়া তৃতীয় নয়ন ।১৯৫৯ এ স্নাতক হলেন কলকাতার গভঃ কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট থেকে। কাজ শুরু করলেন অ্যানিমেটর হিসাবে। বহু নামী বিজ্ঞাপনের কথা ভাষা হয়ে বেরিয়েছে তাঁর সুচারু নিপুণতায়।তাঁর বিভিন্ন আঁকার মূল বিষয়ের কেন্দ্রে থাকা খুলি, কঙ্কাল এবং তীরের ব্যবহার যে কল্পলোকের জন্ম দিত, তা ছিল মূলতই বেদনাদায়ক। প্রাথমিক রঙ বলতে আমরা যা চিনি, সেগুলোর অধিকাংশই ঠাঁই পেতনা তাঁর দেখাতে।রঙ হিসাবে তিনি প্রায়শই বেছে নিতেন বাদামী বা ছায়া নীল। তাঁর আঁকায় লেয়ারেরা একে অপরকে ছাপিয়ে যেত মাদল নৃত্যে।যে শরীর গুলো জায়গা পেত ক্যানভাসে, তারা যেন সবসময়ই ভিতর থেকে জ্বলছে একটা না নেভা আগুনে পুড়ে।
ব্যবসায়িক ও বিনোদনমূলক কাজে ক্রমশ শূন্যতা অনুভব করে ১৯৬৩ তে বিজ্ঞাপনের চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস -এ। একটি সংগঠন যেখানে শহরের ভাস্কর ও চিত্রকরেরা একে অপরের কাজ নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা এবং সমর্থন যোগাতেন । নিয়মিত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন।অনেক বিনিদ্র রাত কেটে গিয়েছিল সিগারেটের ধোঁয়ায়।তবে চিন্তা জুড়ে ছিলেন পিকাসো; তাঁর সৃষ্টি এবং যাপন নিয়ে তর্ক-আলোচনা।বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের পুরোধা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পাশাপাশি রেম্ব্রাণ্ট এবং পল ক্লী এর প্রভাব এই সময় পাইনের মধ্যে বিরাট ভাবে লক্ষ্য করা যায়।যদিও তিনি সম্পূর্ণভাবে সেই ঘরানার একজন পুরোহিত নন।তবুও নিজের আঁকায় একটু অন্য ছোঁয়া রাখলেন। তাঁর অন্ধকারের ব্যাখ্যা ছিল মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটের নীরব ব্যথা।
জলরঙে শুরু। শেষে বেছে নিয়েছিলেন পনেরো শতকে ইয়োরোপ এর সবথেকে প্রচলিত মাধ্যম টেম্পেরা কে। আলো- আঁধারীর মিশেলে ক্যানভাসের কথাই পাল্টে ফেলতেন তিনি।তাঁর হাতে এই মাধ্যম আর শৈলী একসঙ্গে মিশে জন্ম দিত একটা বিক্রিত জগতের। যেখানে অসহায় মানুষ আর ভয়ঙ্কর প্রাণীরা মিলেমিশে থাকতো।১৯৬৯ এ প্যারিসে,তারপর ইয়োরোপ হয়ে উত্তর আমেরিকা – বিভিন্ন প্রদর্শনীতে যোগ দেন। যদিও একক কাজের প্রদর্শনী তখনও করে ওঠেননি। স্বচ্ছ থেকে অস্বচ্ছের দ্বন্দ্বে,নিজেকেই একসময় জনমানব থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন।
সাঁঝবেলায় মহাভারত কে বেছে নিয়েছিলেন নিজের সত্তার পরিচায়ক রূপে। মহাকাব্যের চর্চিত মুহূর্ত গুলিকে বাদ দিয়ে তুলনামূলক ভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ও মুহূর্ত গুলিকে বাছলেন নিজের দর্শনে। ২০১০ এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীতে তিনি বলেছিলেন,” মহাভারতে সুখের কিছুই নেই”।প্রীতিশ নন্দী, মুম্বাইয়ের একজন নামজাদা অঙ্কনশিল্পী,চলচ্চিত্র ও সাংবাদিক ব্যাক্তিত্ব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এর পর বলেছিলেন তাঁর আঁকায় একটা নিখুঁত বর্ণনা রয়েছে যা তাঁর অসাধারণ শিল্পী মনের রূপক।সেগুলো জীবনের কথাই বলে।তাঁর কল্পনায় যে অন্ধকার স্তর, সেখান থেকেই এগুলির সৃষ্টি। যদিও ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তিনি আবার নাকি এর উল্টো মেরুর বাসিন্দা। এম এফ হুসেইন, তাঁর পছন্দের দেশের সেরা দশ চিত্রকর দের মধ্যে একমাত্র বেছে নিয়েছিলেন এই বঙ্গ সন্তানকেই।