দিনে পাঁচবার নিষ্ঠাভরে নামাজ পড়েন। সঙ্গে চলে নিষ্ঠা সহকারে নিজের কাজ। আপনারা কি আন্দাজ করতে পারছেন, কি কাজ করেন মহম্মদ শেখ? শুনুন তাহলে। মুম্বই শহরে রীতিমত প্রতিষ্ঠিত প্রতিমা শিল্পী মহম্মদ। হ্যাঁ, একদম ঠিক শুনছেন। তার জীবনের এই পথ অতিক্রম করতে লেগেছিল বেশ কিছু সময়। হঠাৎ করেই ওড়িশা থেকে চলে এসেছিলেন মুম্বইতে। তখনও জানেননা, কি করবেন সেখানে। সঙ্গের পয়সা ক্রমশই ফুরিয়ে যেতে থাকল। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, মহম্মদ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন একটা এঁদো গলির ভেতরে একটি বাড়ির এক চিলতে বারান্দায়।
জীবনের মোড় ঘুরেছিল সেই মুহূর্ত থেকেই। বাড়িটিতে তাকে অতিথি হিসেবে রাখা হল। সেই বাড়ির যিনি মালিক, তিনি ছিলেন মূর্তি গড়ার কারিগর। মহম্মদ রোজ বসে বসে মূর্তি গড়া দেখতেন। প্রতিমাশিল্পী দূর্গা, গণেশ, লক্ষ্মী ঠাকুরের মূর্তি গড়েন, সে খুঁটিয়ে সেই কাজ দেখে। কিছুদিন পর থেকে মহম্মদ সেই শিল্পীর হাতে টুকটাক সাহায্য করে দিতে থাকেন। বাঙালি কারিগর কিন্তু সেই টুকটাক সাহায্যের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিল মহম্মদের রয়েছে অসম্ভব কল্পনাশক্তি, যার মাধ্যমে সে অনেক কিছু করতে পারে। মহম্মদ নিজে থেকে একসময় একটি কাঠের টুকড়ো খোদাই করে তৈরী করে ফেললেন একটি গনেশের মূর্তি। শিল্পী যেন তার দূরদৃষ্টিকে চোখের সামনে দেখতে পেলেন। আর দেরি নয়, মহম্মদকে রেখে দিলেন নিজের কাছে মাস মাইনের চাকরিতে। উৎসাহ দিতে থাকলেন আরও ভালো কাজ করার জন্য। নিজের হাতে প্রতিমা গড়তে শুরু করলেন মহম্মদ। তুলির টান ছিল তাঁর নিখুঁত। মাটি, কাঠ, পাথর-যাই হাতের কাছে থাকুক না কেন, মহম্মদ তাই দিয়েই নিখুঁত প্রতিমা বানিয়ে ফেলেন। নিজের কাজের ফাঁকে মুম্বইয়ের যত প্রখ্যাত প্রতিমা শিল্পী আছে, তাদের সবার কাজ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন মহম্মদ। বিভিন্ন প্রতিমা বিক্রির সময়ও সেখানে হাজির থাকতেন। সেই জ্ঞান কাজে লাগাতেন নিজের মূর্তি গড়ার সময়। সারা মুম্বই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন সে টিমটিমে বাল্বের আলোয় গণপতি বাপ্পা অথবা মা দুর্গার চোখ আঁকছেন।
মহম্মদ মুম্বইয়ের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলেও ঘুরতেন। প্রতিমাশিল্পীর কাছ থেকে মন্ডপে নিয়ে আসার সময় অনেকসময় মূর্তি নষ্ট হয়ে যেত। সেগুলি তিনি সারিয়ে দিতেন। এর জন্য তিনি কোনো রকম পারিশ্রমিক নিতেন না। নিজের কাজকে অনেক রকমভাবে পরীক্ষা করার জন্যই তিনি এই কাজ করতেন। তাঁর হাত দিয়ে যদি মূর্তিটি আগের চেহারা ফিরে পায়, সেটাই হবে তাঁর আসল পারিশ্রমিক-মনে করতেন মহম্মদ। বছরের বিভিন্ন সময়ে মুম্বইয়ের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে যোগ দিতেন তিনি। বিখ্যাত প্রতিমাশিল্পীদের বক্তব্য শুনতেন। নিজের বক্তব্যও রাখতেন। তাঁর নাম শুনে সকলেই একবার করে দেখে নিতেন তাঁকে, কিন্তু কেউ কোনোদিন নিরুৎসাহ করেননি, তাও ভোলেন না মহম্মদ। মুম্বই তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছে। তাই এই শহরের প্রতি তিনি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ।
ভাইন্ডারের বেকারি লেনে, মুম্বই শহর থেকে সামান্য দূরে ৩৯ বছরের মহম্মদ শেখের নিজের প্রতিমা তৈরির ওয়ার্কশপ রয়েছে এখন। সেখানে তিনি গণেশের মূর্তি গড়েন। বর্তমানে তিনি মুম্বইয়ের বিখ্যাত ও পরিচিত প্রতিমাশিল্পী। প্রতিমার অর্ডার পান তিনি প্রখ্যাত চিত্রতারকা থেকে বিভিন্ন শিল্পপতিদের কাছ থেকেও। বছরে ২০০ টিরও বেশি গণপতিবাপ্পা মূর্ত হন তাঁর হাতের ছোঁওয়ায়। গড়েন মা দুর্গার মূর্তিও। তবে সেখানকার অতিকায় গণেশমূর্তির যে রেওয়াজ রয়েছে, তাতে তিনি বিশ্বাসী নন। মহম্মদ মনে করেন ছোট প্রতিমাই তাঁর হাতের ছোঁওয়ায় নিখুঁত হয়। এর পাশাপাশি তিনি প্রতিমা তৈরিতে ব্যবহার করেন প্রাকৃতিক রং-এর বদলে ভেষজ রং। দূষণমুক্ত ও প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে নিজেও যেমন প্রতিমা তৈরী করেন, তেমনি সেই উপাদান দিয়ে অন্যদেরও মূর্তি গড়ায় উৎসাহ দেন। একবার একটি সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে তিনি মুম্বইবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন তারা যেন অব্যবহৃত বই বা ফুল ফেলে না দিয়ে তাঁকে দিয়ে যায়। তাই দিয়েই তিনি মূর্তি গড়েন।
রমজানের মাসেও রোজ নিয়ম করে মূর্তি গড়েন মহম্মদ। তিনি বিশ্বাস করেন, ভগবান তাঁর হাতেই সুন্দর ও নিখুঁত মূর্তি তৈরির দায়িত্ব দিয়েছেন।