"সং দেখার জন্য লোকের অসম্ভব ভীড় হয়েচে- কুমোর, ডাকওয়ালা এবং অধ্যক্ষরা থেলো হুঁকোর তামাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ও মিছিমিছি চেঁচিয়ে গলা ভাঙচেন! বাজে লোকের মধ্যে দু একজন আপনার কর্তৃত্ব দেখাবার জন্যে ' তফাৎ তফাৎ' কচ্চে, অনেকে গোছালো গোছের মেয়েমানুষ দেখে সং- এর তর্জমা করে বোঝাচ্চেন! কলকাতার রাস্তায় উৎসবের এই ছবি পাওয়া যায় হুতুমের লেখনীতে। উত্তর কলকাতার গাজন পরবের। পুরনো কলকাতায় চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সঙ।
সং এর মিছিল বেরত। আর তা দেখার জন্য লোকের ভিড় জমাত রাস্তায়।
সমাজের সব স্তরের মানুষকে দেখা যেত সেই ভিড়ে। কলকাতায় সঙ দেখতে সবচেয়ে বেশি লোক জমায়েত হত কাঁসারি পাড়া অঞ্চলে। হুতুমের নকশায় তার বহু বিবরণ পাওয়া গিয়েছে। উনিশ শতকের কলকাতায় লৌকিক উৎসবের অন্যতম অঙ্গ ছিল সঙ। প্রধান উদ্দেশ্য সাধারণের মনোরঞ্জন হলেও সামাজিক- রাজনৈতিক পরিস্থিতি উঠে আসত রঙ্গ- ব্যঙ্গের আড়ালে।মূলত শহরের প্রান্তিক বাসিন্দা যাদের সমাজ কোনভাবেই 'মেইন স্ট্রিম'এ জায়গা দেয় না তারাই এই উৎসব আয়োজনের মূল উদ্যোগ নিত। ঠিক কবে থেকে কলকাতা শহরে সঙের চল হয়েছিল তার কোনও সঠিক সন তারিখ পাওয়া যায় না। তবে মনে করা হয় উৎপত্তিটা চড়ক থেকেই।
সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষরা যার আয়োজনে। পরবর্তী সময়ে গ্রামের মানুষ রুজির টানে শহরমুখী হলে গাজন উৎসবও শহরমুখী হয়। তবে এই উৎসবকে কখনই কোনও বিশেষ শ্রেণীর উৎসবে সীমাবদ্ধ করা যায় না। সে সময়ে পত্র পত্রিকাতেও সং মিছিলের প্রতিবেদন উঠে এসেছে। কাঁসারি পাড়ার বেনারসি ঘোষ স্ট্রিট থেকে একটি মিছিল সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। সন ১৮৭২। তারিখ ১৮ এপ্রিল।
মিছিলটির উদ্যোক্তা ছিলেন কৃষ্ণদাস পাল। সেই সময় ' হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকা বের করতেন তিনি। সঙের মিছিলের অভিনেতাদের গানের ভাষা ছিল চটুল। একেবারে রোজকার মুখের ভাষাতেই গান বাঁধতেন তাঁরা। কলকাতা শহরের জীবনের চলচিত্র ধরা দিত গানের কথায়। বাইরে থেকে রুটি রুজির টানে যারা আসতেন এ গান যেন তাঁদের চোখে দেখা সমাজ দর্পন। ১৯২০ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের ধাঙড়রা ধর্মঘট করেছিল। সেই ঘটনা গান হয়ে উঠে সঙের মিছিলে।
ছোটা বড়া সব বাবুকা দেতা হ্যায় সালাম,
জলদি সাফা করি হামি ড্রেন- ঝাঁঝরার কাম।।
শুনো বাবুলোগ মানী, মুলুকমে ভেজা কোম্পানী;
আগারি কাম কর দেগা, নেহি হোগা বদনাম।।
ঝাঁঝরিকা পাঁক নেহি রাখেগা, উসকো বাহার ফেককে দেগা;
বাবুসে বকশিস লেগা, নাহি ছোড়েগা হাম।।
(১৯২০) সঙের মিছিলে থাকত মুচি, মেথর,জেলে, কামার, সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির মানুষরা। তাদের জীবন তাদের গানে শ্লেষ হয়ে বিঁধত সমকালকে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফল হিসেবে তৈরি হয় জেলা পাড়া সং সংগঠন সমিতি। বহু লেখক শিল্পী সঙ- এর গান লেখার জন্য এগিয়ে আসেন। দাদাঠাকুর, কালিদাস রায় এর মতো মানুষদের দেখা যায়। সঙের গান ধীরে ধীরে চরিত্র বদলাতে শুরু করে। মনোরঞ্জন এর ঝাঁজ কমে রাজনৈতিক প্রচারের মুখড়া। এর দু'রকম ফল হয়। একদিকে যেমন বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রবেশ করে এই গান তেমনি অন্যদিকে সাধারণ মানুষ যারা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্যই এই গানে আগ্রহ দেখাত তারা ক্রমশ বিমুখ হতে থাকে।
ব্রিটিশ সরকারও নজর করতে শুরু করে। ১৮৭৬ সালে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বড় বাধা আসে। ১৯৩০ সালে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এই আশঙ্কায় নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় সঙ-মিছিল। তারপরে সঙ এর মিছিলে রাস্তায় দেখা গেলেও তার সেই উৎসাহ আর ছিল না।স্বাধীনতার পরেও ছবিটা একই থাকে। বহু দশক বন্ধ থাকার পর আবার নতুন করে ফিরে আসে ১৯৯৩ সালে। প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র এবং অন্যান্য ব্যক্তিত্বদের উদ্যোগে।