বাদল সরকার জন্ম দিয়েছিলেন ‘থার্ড থিয়েটারে’র। লাতিন আমেরিকার ‘থার্ড সিনেমা’র আদলে।
হলিউডের সিনেমার ছক ভেঙ্গে লাতিন আমেরিকার প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল থার্ড সিনেমা। বাংলায় সেভাবেই থার্ড থিয়েটার। প্রসেনিয়াম থেকে বেরিয়ে মাঠ-ঘাট-রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভিনয়। দর্শক আর মঞ্চের মাঝখানের দূরত্বটাকে কমিয়ে দেওয়া। অভিনয়ের দৃশ্য থেকে ছিটকে আসা রাগ-ঘেন্না-ভয়-ভালবাসা গায়ে লেগে থাকে দর্শকদের। মন মাথা কামড়ে আঁকড়ে বসে থাকে।
বাদল সরকার আর নেই। থার্ড থিয়েটারের পাগলা ঘোড়াও কিছুটা শ্রান্ত। সময়ের স্মৃতি থেকে ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে ইতিহাস।
কিন্তু আছে ওরা। থার্ড স্টেজ। কলকাতার বুকে তৃতীয় মঞ্চ।
মঞ্চ লাগে না। সজ্জা লাগে না। আলো-এসি, ভরা প্রেক্ষাগৃহ কিছুই লাগে না ওদের। ক্ষ্যাপা শহরের অলি-গলি-ফুটপাথে ভায়োলিন আর গিটার হাতে গান গেয়ে বেড়ান একুশ আর তেইশের দুই ‘পাগলা ঘোড়া’। সৌরজ্যোতি আর কৃষ্ণেন্দু।
নাট্যকার বাদল সরকারকে ট্রিবিউট জানিয়ে ওরা নিজেদের দলের নাম রেখেছে ‘থার্ড স্টেজ’। দুজনেই স্নাতক স্তরের ছাত্র। পড়ার সিলেবাসে সিনেমা আর গান। কসবার সৌরজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে এবং বেঙ্গল মিউজিক কলেজে আছে বেহালার কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
কালীঘাট, রাসবিহারী, টালিগঞ্জ, কিংবা ঢাকুরিয়া লেকে নিয়মিত দেখা যায় ওদের। বেশিরভাগ দিন দু’জনে একসঙ্গে। আবার কোনওদিন-কোনও দিন সৌরজ্যোতি একা।
রবি ঠাকুর থেকে ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দু, ফোক কিংবা বিদেশি সুর। সুরেরা আদল ভেঙে খুঁজে নেয় অন্য শরীর। হাওয়ার টানে ছড়িয়ে পড়ে । থমকে যায় ফুটপাত।
গানের জন্য খুঁজে নেয় শেষবেলা। ওদের কথায় এই সময় ঘরে ফিরতে শুরু করে মানুষ। অফিসের তাড়া থাকে না। গান শুনে দাঁড়িয়ে যাবার অবসর থাকে। থার্ড স্টেজের গান শুনে মুগ্ধতা জানিয়ে যায় অনেকেই। অনেক অন্যরকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী ওরা। কেউ চলন্ত অটো থেকে নেমে দাঁড়িয়ে যায় ওদের বাস্কিং-এ। ভালবেসে টিপস রেখে যান সামনে খুলে রাখা ভায়োলিন বক্সে। বাঁকা কথাও যে উড়ে আসেনি এমন নয়।
সৌরজ্যোতির কথায়, “অনেকেই প্রথমে দেখে বলত, এভাবে কেন?
গত বছর অক্টোবর থেকে বাজাচ্ছেন দু’জনে। আগে পার্ক স্ট্রিটে নিয়মিত দেখা যেত তাদের। কখনও ট্রিঙ্কাস, কখনও মিউজিক ওয়ার্ল্ডের সামনে। কিন্তু বর্ষশেষের রাতে পুলিশি ঝামেলায় আর পার্ক স্ট্রিটে গান গাইতে পারেন না দুই তরুণ।
মঞ্চেও পারফর্ম করেন সৌরজ্যোতি। দুজনের-ই আলাদা আলাদা দল আছে। কিন্তু থার্ড স্টেজ মানে ওঁরা দুজনেই। রাস্তাকেই বেছে নিয়েছেন মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছানর জন্য।
সৌরজ্যোতি ভায়োলিন বাজান। গান করেন কৃষ্ণেন্দু, সঙ্গে গিটার। দুজনের আলাপ হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমে। তারপর গানে গানে বন্ধুত্ব। কিন্তু ওঁরা গান করেন নিজেদের খুশিতে। অনেক সময় দর্শকদের থেকেও অনুরোধ আসে। ঘিরে ধরে গান শোনে মানুষ।
এভাবে রাস্তায় গান, লাইভ মিউজিক খুব জনপ্রিয় বিদেশে। কিন্তু কলকাতায় সেভাবে দেখা যায়নি। ভাবনাটা প্রথম এসেছিল সৌরজ্যোতির মাথায়। খুব দিনক্ষণ দেখে প্ল্যান পরিকল্পনা করে শুরু করেননি। অনেকটা দুম করেই। থার্ড স্টেজের গান থামিয়ে দিয়েছিল পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ব্যস্ত ফুটপাতটাকে। মঞ্চের অভিজ্ঞতা ছিল তাই রাস্তায় পারফর্ম করতে সেভাবে কোনও জড়তা ছিল না।
দুজনেই ছোটবেলা থেকে গানের পরিবেশে বড় হয়েছেন। রাস্তায় বাস্কিং করে যে টাকা পান তাই দিয়ে নিজেদের ইন্সট্রুমেন্ট কেনেন ওঁরা।
আগে শুধু মাত্র কলকাতার রাস্তায় দেখা গেলেও এখন কলকাতার আশেপাশের অঞ্চলেও গান শোনাতে যান দুজনে। কিছুদিন আগেই গিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর।
তবে থার্ড স্টেজের কোনো বাঁধা-ধরা জায়গা নেই। যেমন ইচ্ছে, যেখানে খুশি গান গেয়ে বেড়ান। নিজেদের শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্রমশ হয়ে উঠছেন পরিচিত মুখ। রাস্তাঘাটে চিনতে পারছে মানুষ। ওদের ফেসবুক পেজেও ভালবাসা জানিয়ে যান মানুষ। সামনাসামনি কথা বলে উঠতে না পারলে আছে সোশ্যাল মিডিয়া।
ওঁরা গান গেয়ে যান। গানে গানে সন্ধে নামে। গলির মধ্যে ঘন হয়ে ওঠে অন্ধকার। দিনের শব্দ ক্লান্ত। ওদের গান জেগে থাকে। ‘গানওয়ালা’র ডাক এড়ানো যায় না কোনভাবেই। যে পথ দিয়েই ফিরে যাও না কেন হাওয়ায় হাওয়ায় তার নাছোড়বান্দা সুর ঘিরে ধরবেই। হারিয়ে যেতে বসা ভাঙা শহরটাকে এমন গানওয়ালারা তো বাঁচিয়ে রেখেছেন।
হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে থাকে যে জীবন, ক্যাসেট সিডি বা দূরে বাজা মাইকের উড়ে আসা গানে কান পেতে থাকে। কুড়নো কাগজের রাংতায় নিতে চায় জীবনের আস্বাদ তাদের কাছে থার্ড স্টেজ বিকেলের একটুকরো আলো। ঝেঁপে আসা ভালোবাসা। তাই সৌরজ্যোতির ভায়োলিনটা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেও তারা অধৈর্য হয়। বলে ওঠে, “কী গো কাকু তোমার গানটা বাজাও”...