মুম্বইয়ের কুরলা বস্তি থেকে ভার্জিনিয়ার ইউনিভার্সিটি- জীবনের পথে স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছেন জয়কুমার

এইজন্যই বোধহয় বলে স্বপ্ন যদি দেখতে হয়, দিনের বেলায় দেখো। রাতে ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখা হয়, তা ঘুম ভাঙলেই ভুলে যাই আমরা। কিন্তু দিনের বেলায় কঠোর বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করেও যে স্বপ্ন জিইয়ে রাখার সাহস দেখাতে পারে, স্বপ্ন তার হাতেই ধরা দেয়। তার এইমুহূর্তে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল জয়কুমার বিদ্যা।

           এ মাসের ১৫ আগস্ট তিনি ভার্জিনিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে তাঁর দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলে, তা ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর সেখান থেকে ডাক পান তিনি এবং পাড়ি দেন স্বপ্নের উড়ানে।

             তবে জীবনের শুরুটা কিন্তু এরকম ছিলনা। মুম্বইয়ের কুরলা বস্তিতে মাত্র ৭৫ স্কোয়ার ফুটের ঘরে বেড়ে ওঠা জয়কুমারের। সিঙ্গল মাদার হিসেবে তার মায়ের দারিদ্রের সঙ্গে তুমুল লড়াই-ই বুঝি জয়কুমারকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিল। মা-ছেলের দিন কাটত কোনোদিন পাওভাজি খেয়ে তো কোনোদিন শুধু চা-সিঙ্গারা খেয়ে। আলাদা করে কোনোরকম লাঞ্চ বা ডিনারের ব্যবস্থা ছিলনা। পরনের পোশাক ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড। চরম দারিদ্রতার মধ্যে একবার স্কুলের ফি'স দিতেও সমস্যা হয়েছিল জয়কুমারের মা নলিনীর। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে শুনতে হয়েছিল, টাকা না থাকলে পড়াশুনো হয়না, জয়-কে যেন তার মা গাড়ি চালাতে শেখান।

তারপর এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'মেসকো' সঙ্গে যোগাযোগ হয় নলিনীর। তারাই জয়কুমারের স্কুলের বাকি থাকা মাইনে দিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে কলেজে পড়ার সময় সুদ ছাড়া ঋণ-ও দেয়। 'ইন্ডিয়ান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন'-ও জয়কুমারের স্বপ্ন সফল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্কুলে পড়াকালীন কোনো রকম পিকনিক, বা বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খাওয়া অথবা হ্যাং-আউটে যাওয়া তার কাছে ছিল বিলাসিতা। আর্থিক অনটনের সঙ্গে পাল্লা দিতে জয়কুমার একটি টিভি মেরামতির দোকানে ৪০০০ টাকার মাইনেতে কাজ নেয় এবং পাশাপাশি কিছু ছাত্র পড়ানো শুরু করে। কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায়ের জোরে কে জে সোমাইয়া কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক হন জয়কুমার। রোবোটিক্সে তিনটে জাতীয় এবং চারটে রাজ্যস্তরের পুরস্কার পান। 

                      জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে এই সময় থেকেই। কলেজে পড়াকালীন প্রথম চাকরির প্রস্তাব আসে লারসেন অ্যান্ড টুবরো থেকে। কলেজ পাস করেই তিনি টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-(টি এই এফ আর) এ কাজ পান। মাইনে ছিল ৩০,০০০ টাকা। দু'মাসের মাইনে জমিয়ে প্রথম নিজের বাড়ির জন্য একটি এসি কেনেন জয়, তারপর বাড়ির সংস্কার করেন। জিআরআই এবং টিওইএফএল পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিল আপ করেন। এই ফর্ম ফিল আপ-এর  জন্য বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যায়। সেই ঘাটতি মেটাতে এবারে অনলাইন টিউশন শুরু করেন জয়কুমার। তিন বছর টিআইএফআর -এ কাজ করার পর জয়কুমার পিএইচডি শুরু করেন। এই রিসার্চ ওয়ার্কের ফলস্বরূপ তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে। এখান থেকেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার। একসময় মাসের শেষে যাঁদের হাতে পড়ে থাকত মাত্র ১০ টাকা, মাত্র ২৪ বছর বয়সে আজ তাঁরই মাসিক স্টাইপেন্ড ২৩,৪০০ ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ ৪৩ হাজার টাকার কিছু বেশি। এর থেকে মাত্র ৫০০ ডলার জয়কুমার নিজের জন্য রেখে বাকি সব টাকা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। খুব তাড়াতাড়ি মা-কে আমেরিকাতেও এনে নিজের কাছে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে জয়কুমারের। টিআইএফআর-এর প্রফেসর মন্দার এম দেশমুখ, যিনি জয়কুমারের মেন্টর ছিলেন, তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রফেসর দেশমুখের কথায় জয়কুমার প্রচন্ড হার্ডওয়ার্কিং। খুব পরিশ্রম করতে পারে। এইরকম ছেলে এখন খুব কম দেখা যায় বলে মনে করেন তিনি।

 

                  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...