বাংলার পাগড়ি ও আফগান মস্তক

আফগানিস্তান, বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের অপর নাম আফগানিস্তান। আমাদের কাবুলিওয়ালাদের সেই দেশ এখন তালিবানদের দখলে। প্রতিবেশি দেশ জুড়ে এখন কেবলই স্বাধীনতার সঙ্কট, মানবাধিকারের অপমৃত্যু। একদা গান্ধারীর গান্ধার অবস্থিত ছিল এই আফগানিস্তানেই। এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিম ছিল আফগান স্নো। যদিও এই ক্রিম কিন্তু ছিল খাঁটি ভারতীয়, শুধু নামেই আফগান।

 

কিন্তু এসবের জন্য নয়, বাঙালীরা বহুদিন ধরেই কাবুল আর কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে পরিচিত। বঙ্গসন্তানদের শৈশবের স্মৃতিতেই আঁকা হয়ে যায় কাবুলিওয়ালাদের ছবি। আমাদের যে একটা রবি ঠাকুর রয়েছেন। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি, কাবুলিওয়ালা পড়েনি এমন বাঙালী হয়ত ভূ-ভারতে মিলবে না। আমরা সবাই মিনি, আর মিনি খোকি হয়েই আমরা কাবুলিওয়ালাদের খোঁজ করি।

 

রবি ঠাকুরের এই গপ্পো নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলেন তপন সিংহ, বাঙালির হৃদয়ের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যায় কাবুলিওয়ালারা। মনে পড়ে রহমতের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসকে। কুর্তা-পাজামা পরা, মাথায় পাগড়ি দেওয়া পাঠান। হ্যাঁ, কাবুলিওয়ালাদের এই ছবিই তো আমাদের মনে এঁকে দিয়েছেন রবি ঠাকুর।

Afghanistan1

তোমার ঝোলায় কী আছে? এতে...? এতে হাতি আছে। এই রকম স্নেহ-ভালোবাসা মাখা এক বন্ধুর বন্ধুত্ব বোধহয় ছোট্টবেলায় আমরা সবাই চাইতাম। কাবুল থেকে শুকনো ফল, হিং বেচতে ওরা আসতেন আমাদের দেশে, আমাদের শহরে। বাড়ি ছেড়ে এসে আপন করে নিতেন এই দেশকে ও দেশের মানুষদের। সেই কাবুলিওয়ালাদের পরিচয় পাগড়িতেই। এই পাগড়ির জন্যেই বাংলার সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক। ভারী নিবিড় সে যোগাযোগ।

 

এই বাংলাই দীর্ঘদিন ধরে কাবুলে পাগড়ি পাঠাচ্ছে। কাবুলিদের পাগড়ি পরাচ্ছে আমাদের বাংলা। বাঁকুড়ার সোনামুখী, মন্ডার জন্যে যার খ্যাতি প্রশ্নাতীত। সেই সোনামুখীই বহুদিন ধরে আফগানদের 'আন-বান-শান'-এর অর্থাৎ পাগড়ির সরবরাহ করে আসছে। একজন আফগানের জন্যে তার পাগড়িই তার সম্মানের প্রতীক।

 

সোনামুখী শহরের পাগড়ি শিল্পের ইতিহাস সুপ্রাচীন। কেবল প্রাচীনই নয়, সেই সঙ্গে গর্বের ও সমৃদ্ধির। জনশ্রুতি অনুযায়ী, একসময় আফগানিস্তান থেকে এই অঞ্চলে হিং বিক্রি করতে আসতেন কাবুলিওয়ালারা। ব্যবসার কারণেই মাসের পর মাস এই সোনামুখীতেই থেকে যেতেন তারা। এই সময় কাবুলিওয়ালাদের মাথার পাগড়ির অনুকরণে সোনামুখীর কৃষ্ণবাজারের তাঁতিরা পাগড়ি তৈরি করতে শুরু করেন। যা আজও চলেছে।

 

এই ভাবেই শুরু হয় পাগড়ির ব্যবসা, আজও অক্ষত সেই ব্যবসা। দিন যত এগিয়েছে ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সোনামুখীর কৃষ্ণবাজার থেকে পাগড়ি কিনতেন স্থানীয় কাবুলিওয়ালারাই। ধীরে ধীরে সেখানকার তাঁতিদের ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকে। ভাল দাম পেতে শুরু করায়, সোনামুখীর তন্তুবায় পেশায় যুক্ত মানুষেরা ধীরে ধীরে গামছা, চাদর সব ছেড়ে দিয়ে পাগড়ি বানাতে শুরু করেন।

Afghanistan2

সোনামুখীর পাগড়ি রফতানি হতে শুরু হয়। কলকাতা আর দিল্লির রফতানিকারী একাধিক সংস্থার হাত ধরে সোনামুখীর পাগড়ি এখন কাবুলের পাগড়ির বাজারের দখল নিয়েছে। সেদেশে একাধিপত্য স্থাপন করেছে বাংলার পাগড়ি, কাবুল কান্দাহারের বাজার ছেয়ে ফেলেছে বাংলার পাগড়ি।

 

বিগত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে চারশো থেকে চার হাজার টাকা, সব দামের পাগড়িই পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। আফগানিস্তান ছাড়াও এখন সৌদি আরব ও পাকিস্তানে সোনামুখী থেকেই পাগড়ি রফতানি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে বাঁকুড়ার তৈরি এই সিল্কের পাগড়ির প্রচুর চাহিদা। সোনামুখীর এই সৌখিন পাগড়ির কদরও রয়েছে ব্যবহারকারীদের মধ্যে।

 

কিন্তু হাল আমলে খানিক ভাঁটা পড়েছে এই পাগড়ির ব্যবসায়। তালিবানের আক্রমণ ও তালিবানী আগ্রাসন নষ্ট করে দিয়েছে সাজানো বাগান। ওলটপালট করে দিয়েছে কাবুলকে, পাগড়ির ব্যবসার চেনা ছবি আর ধরা দিচ্ছে না সোনামুখীতে। নেই কোনও ব্যস্ততা। সোনামুখীর তাঁতিদের যেন অনন্ত অবসর যাপন চলছে।

 

সেই শেষ জুলাই মাসে পাগড়ি রফতানি হয়েছিল। তারপর প্রায় দেড় মাস কেটে গিয়েছে। কবে পরিস্থিতি ফের ঠিক হবে, সেই আশাতেই দিন গুণছেন তারা। তবে পাগড়ি উৎপাদন তারা থামিয়ে দেননি, তারা বুনছেন। কিন্তু মূলধনে টান পড়ছে। বিক্রি বন্ধ, সামনে বাংলায় শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয়া।

 

কিন্তু এই সময় ব্যবসা থেমে যাওয়ায় রুটিরুজির সমস্যায় পড়েছেন কৃষ্ণবাজারের হাজার হাজার পাগড়ি শিল্পী ও তাদের পরিবার। আবার পরিস্থিতি ঠিক হোক, ফের রফতানি শুরু হোক। সোনামুখীর পাগড়িতেই সেজে উঠুক আফগানরা। এইভাবেই কাবুলিওয়ালাদের, আমাদের রহমতদের যুগ যুগ ধরে পাগড়ি পরিয়ে যাক বাংলা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...