সে একটা সময় ছিল বটে! তখন খাঁকি রঙের বাঘ মার্কা পোস্ট-কার্ড ছিল, আকাশি রঙের গোপনবিলাসী ইনল্যান্ড লেটার ছিল, ডাক টিকিটের দাবি নিয়ে বিচিত্র সব খাম ছিল, পাড়ার মোড়ে মোড়ে লাল-কালো লেটার-বাক্স ছিল, ডাক-পিয়নের জন্য পথ চাওয়া ছিল, প্রিয় চিঠির জন্য অপেক্ষা ছিল। চিঠিতে তখন প্রেম হত, নিরুত্তরে ব্যর্থ হত, চিঠিতে মন উজাড় হত, ক্ষোভে 'পত্রাঘাত' হত, চিঠি পেতে দেরি হত, কত অভিযোগ হত, শত কৈফিয়ৎ হত, ক্লাসে চিঠি পাঠ্য হত, গতে লেখা শেখা হত, চিঠির বন্ধুতা হত, চিঠিতেই প্রগাঢ় হত। আর সেই বন্ধুতার নাম দেওয়া হত, 'পত্রবন্ধু' বা 'পত্র-মিতালী'।
প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে পত্রবন্ধুত্ব ঠিক কীভাবে গড়ে উঠত তার একটি সুন্দর বিবরণ আছে সত্যজিৎ রায়ের লেখা, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দের পূজাবার্ষিকী "আনন্দমেলা" পত্রিকায় প্রকাশিত "স্বর্ণপর্ণী"-গল্পে। গল্পটা প্রফেসর শঙ্কুর জবানিতে। হ্যাঁ, সন্ডার্সের সঙ্গে তাঁরই পত্রবন্ধুত্বের গল্প :
"আমি তখন কলকাতায়।...'নেচার'...পত্রিকায় জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে একটা চমৎকার প্রবন্ধ পড়ে আমি লেখক জেরেমি সন্ডার্সকে তার বাসস্থান লন্ডনে একটা চিঠি লিখি। 'নেচার'-এ লেখক পরিচিতিতে বলা হয়েছিল সন্ডার্স দু'বছর হল কেমব্রিজ থেকে বায়োলজি পাশ করে বেরিয়েছে। আন্দাজ মনে হয় সে আমারই বয়সি হবে।
"তখন বিলেতে চিঠি যেতে জাহাজে লাগত আঠেরো দিন, আর প্লেনে আট দিন। আমি এয়ারমেলেই লিখেছিলাম। সন্ডার্সের উত্তর এল উনিশ দিন পর। অর্থাৎ সেও এয়ারমেলেই লিখেছে। সে যে আমার চিঠি পেয়ে শুধু খুশি হয়েছে তাই নয়, সে নাকি চিঠিতে এক বিরল বিদগ্ধ বৈজ্ঞানিক মনের পরিচয় পেয়েছে। শেষ ক'লাইনে সে জানিয়েছে যে, তার জন্ম হয় ভারতবর্ষের পুণা শহরে।..
"চিঠি লেখালেখি চলল। তৃতীয় চিঠিতে সন্ডার্স লিখল, 'যদিও আমাদের দু'জনেরই বয়স পঁচিশ, আমি বিশ্বাস করি না যে এই বয়সে পত্রবন্ধু হওয়া যায় না। তুমি আমার মতে সায় দাও কি না সেটা জানার অপেক্ষায় রইলাম।'
"আমি স্বভাবতই সন্ডার্সের প্রস্তাবে রাজি হলাম। পরস্পরকে ছবি পাঠানো হল, অপ্রতিহতভাবে চলতে লাগল এয়ারমেলে চিঠি যাওয়া আসা।"
প্রফেসর শঙ্কুর পঁচিশ বছর বয়সটা আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পূর্বেকার অর্থাৎ বিশ শতকের একবারে প্রথমদিকের সময়টাকে নির্দেশ করে। তবে, 'পত্র-বন্ধু' কনসেপ্টটি পাশ্চাত্যে বেশ পুরনো। ভিন্ন দেশের দুই সমাজ-সংস্কারপন্থী কার্ল মার্ক্স এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের মধ্যে 'পেন-ফ্রেণ্ডশিপ' বা পত্র-বন্ধুতার কথা জানা যায়। আরও জানা যায়, বিশ শতকের প্রথম তিন দশকের মধ্যেই 'পেন-ফ্রেণ্ড' শব্দের সমার্থক হিসেবে 'পেন-প্যাল' শব্দটির অভিধানে জায়গা করে নেওয়ার কথা। তবে তিনের দশকে আমেরিকার স্কুল শিক্ষকদের উৎসাহেই সর্বপ্রথম দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পৃথিবীর নানান দেশের ছাত্রছাত্রীদের পত্রমারফৎ বন্ধুত্ব ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে মুক্ত-শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা শুরু হল। গড়ে উঠতে শুরু করল 'পেন-প্যাল ক্লাব'। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বয়-স্কাউটস সংগঠন এই কাজে সহায়তা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটা যেন বেশ রাতারাতি বিপ্লবের চেহারা নিল।
'পেন-প্যাল' -বিপ্লবের ঢেউ ধীরে ধীরে একসময় ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছল। বাংলাতেও এল। 'পেন-প্যাল'-এর অনুবাদ করা হল, 'পত্র-মিতালী'। বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকার পাতায় নিয়মিত এক নতুন বিজ্ঞাপনী কলাম দেখা যেতে লাগল, যার শিরোনাম, 'পত্র-মিতালী'। বন্ধুত্বে উৎসুক যে-কোন কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-তরুণী নাম-ঠিকানা দিয়ে বন্ধুত্বের আহ্বান জানাতে লাগলেন এই কলামে। বিনিপয়সায়। অপরদিকের উৎসাহীরাও সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন। দেখা-সাক্ষাৎ নেই, নাম-ঠিকানাটুকুই সম্বল। শুধু হাতের লেখা আর আবেগময় প্রকাশভঙ্গির পরিচ্ছন্নতা দিয়েই পাতার পর পাতায়, চিঠির পর চিঠিতে একে অপরকে চেনা, তা থেকেই একটা বিশ্বাস--এভাবেই রচিত হতে লাগল দূর-বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তারপর চিঠি চালাচালি হতে হতে একসময় খামে খামে একে-অপরের ছবির আদান-প্রদান, দুই বন্ধুর দেখা সাক্ষাৎ, বাড়িতে যাতায়াত—এরকমও ঘটতে লাগল। আবার কালের প্রবাহে একপক্ষের উৎসাহে হয়তো ভাটা পড়ল, তখন চিঠিচাপাটি বন্ধ হয়ে বন্ধুতায় ছেদ পড়ল--এমনও দেখা গেল।
গত শতকের আটের দশক ও নয়ের দশকের শুরুতে ছাত্রপাঠ্য পত্রিকা প্রকাশে যেমন জোয়ার এসেছিল, তেমনি এইসব পত্রিকাগুলো 'পত্রবন্ধু'তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তবে, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে, সেই দূর-বন্ধুত্বে কিন্তু যথেষ্ট রোমান্স ছিল, অ্যাডভেঞ্চার ছিল এবং তাই এটি ‘ব্লাইন্ড’ বন্ধু-নির্মাণে একসময় ব্যাপক সাড়াও ফেলেছিল। বাঙালির প্রেম-বন্ধুতা-সম্পর্কের ইতিহাসে এর একটা বিশিষ্ট অবদান আছে। পত্রবাহিত সেই সম্পর্কের সুললিত খতিয়ান পাওয়া যায় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ'র লেখা 'সবিনয় নিবেদন'(১৩৯৬ বঙ্গাব্দ), 'চানঘরে গান'-এর মতো ভিন্নধারার উপাখ্যানমালায়।
‘পত্র-মিতালী’-তে যে একে-অপরকে না-দেখে বন্ধুতা, অপার মুগ্ধতার মোহ এবং সেই মোহভঙ্গের ইতিহাস--তারও কাহিনি রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। রসসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামীর লেখা, ‘চেনা অচেনা’ গল্পে। এই গল্পে পত্র-বন্ধুকে তিনি 'পেন-ফ্রেণ্ড'-এর বাংলা তর্জমায় সম্বোধন করেছেন, ‘লেখনী-বন্ধু’ বলে।
গল্পে দুটি পরিবারের একটি কলকাতা থেকে, অন্যটি বর্ধমান থেকে একই ট্রেনে, একই কামরায় উঠল। দুই পরিবারের দুটি মেয়ে। একটি রোগা, অন্যটি স্থূলা। দূরপাল্লার ট্রেন, কামরায় বেশ ভিড়। ঠেলাঠেলি। চেপেচুপে কোনরকমে পাশাপাশি বসেছে মেয়ে দুটি। কিন্তু, একে-অপরকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। ভাবছে এ-ওকে ইচ্ছে করে চাপছে। তাই নিয়ে একপ্রস্থ তর্কবিতর্ক হল। এবং, কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দুজনেই গুম মেরে গেল। একসময় ওপরের বাঙ্ক খালি হল। স্থূলা তখন চট করে উপরে উঠে গেল। রাত হল। শুয়ে শুয়ে দু'জনেই তাদের লেখনী-বন্ধুর চিঠি পড়তে লাগল। স্থূলা যে চিঠিটি পড়ছে তাতে লেখা:
‘ভাই ডোরা, আমরা কেউ কাউকে দেখিনি, তবু মনে হয় কতদিনের পরিচয়! চিঠি পড়ে মনে হয়, দেখিনি ক্ষতি কি? চিঠির মধ্য দিয়ে তোমার সুন্দর মনটির যে পরিচয় পাচ্ছি, তাই কি কম?’
রোগা মেয়েটি যে চিঠি পড়ছে তাতে লেখা:
‘মিনতি, তোমার চিঠি আমার স্বর্গসুখ।’
চিঠিতে দু'জনেই তন্ময়, দু'জনেই মুগ্ধ। সকাল হতেই স্থূলাদের গন্তব্য-স্টেশন এসে গেল। অমনি স্থূলা হুড়মুড়িয়ে বাঙ্ক থেকে নামতে গিয়ে নীচের রোগা মেয়েটির হাত মাড়িয়ে দিল। ফলে, শুরু হয়ে গেল আর একপ্রস্থ খিচিরমিচির!
শেষমেশ দু'জনেই যে-যার বাড়ি ফিরে তাদের ‘লেখনী-বন্ধু’কে চিঠি লিখল বিচ্ছিরি ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা জানিয়ে। বলাবাহুল্য, রোগা মেয়েটির নাম, মিনতি এবং স্থূলা মেয়েটির নাম, ডোরা। মিনতি লিখল :
“ট্রেনের মধ্যে ‘একটি গেছো মেয়ে' তার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করেছিল, সেই সব কথা।
ডোরাও ঠিক সেই দিনই...একটি রোগা মেয়েকে...গাড়ির মধ্যে কেমন জব্দ করেছিল, সেই কথাটি বেশ রঙ ফলিয়ে বলল। মেয়েটি নাকি চামচিকের মতো দেখতে!”
গল্পের চমকটা এখানেই। বাস্তবের ধাক্কায় মোহভঙ্গের পর এটাই ছিল সম্ভবত তাদের শেষ চিঠি!
পত্রবন্ধু থেকে প্রেম এবং তা থেকে বিয়েও হয়েছে একদা। সিনেমায়। চিঠির যুগ চলে যাওয়ার শেষলগ্নে তামিল 'কাধাল কোট্টা' (১৯৯৬) ছবির অনুকরণে নির্মিত একটি হিন্দি ছবি মুক্তি পেয়েছিল, তার নাম, ‘সির্ফ তুম’(১৯৯৯)। ছবির গল্পে আরতির হারানো সার্টিফিকেট পেল দীপক। বাইপোস্ট পাঠাতে গিয়ে আরতির সঙ্গে তার যোগাযোগ হল। চিঠি চালাচালিতে বন্ধুত্বও হল। আর, তারপর হল প্রেম। এবং, সেটা একে-অপরকে না-দেখেই। শেষমেশ অন্তমিলের গল্প।
দূর-বন্ধুতার আর একটি রকমফের দেখতে পাওয়া যায়, গত শতকের পাঁচের দশকে সাদাত হাসান মান্টো'র লেখা 'বাদশাহত কা খাতমা'-গল্পে। অনেক সময় এমন ঘটনা তো আকছারই ঘটে--রঙ নাম্বার থেকে কতবার ফোন আসে; আর আমরা 'রং নাম্বার' বলে কেটে দিই! ল্যান্ডফোনের যুগে এমন ব্যাপার হামেশাই ঘটত। কিন্তু, যদি ধরুন রং নাম্বারের সূত্রেই দুটি মানুষের ফোনে ফোনে আলাপ হয়? বন্ধুতা হয়? তারা যদি নারী এবং পুরুষ হয়? চেহারা নয়, কণ্ঠ দিয়ে যদি দু'জনকে চেনে? দু'জন যদি কণ্ঠ দিয়ে বিশ্বাস তৈরি করে, ভরসা দেয়, নির্বান্ধব জীবনে পরস্পরের সহমর্মী হয়ে ওঠে?--হ্যাঁ, এভাবেই সম্ভাব্য সত্যে নির্মিত হয়েছে মান্টোর কাহিনি। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের হাতে সেই কাহিনিই ১৯৯৩-এ ‘অন্তরীণ’-নামে হয়ে উঠেছে কাহিনিচিত্র।
চিঠি গেল। ল্যান্ডফোন গেল। সংবাদপত্রের বুকে শুধু 'পত্র-মিতালী' কলামটা রয়ে গেল, নির্মল বন্ধুতা নয়, যৌনতার হাতছানিতে বরুনার বুকের মতো ‘শুধুই মাংসের গন্ধ’ নিয়ে।
একুশ শতক এল। একটু একটু করে আমাদের ব্যক্তিজীবনের ফাঁকা জমিনটুকু দখল করে নিল মোবাইল আর ইন্টারনেট। পকেট এবং হাত দখল করে নিল নানান মাপ ও ফিচারের স্মার্ট ফোন। যোগাযোগ আর বন্ধুত্বের মাধ্যম হয়ে উঠল--'ফ্রি ফোন কল', 'মেইল', 'ফেসবুক', 'হোয়াটস অ্যাপ', 'মেসেঞ্জার'—আরও কত কী! বন্ধুদের মধ্যে দৈনন্দিন কথাবার্তা এবং আড্ডার চেহারাটাই পাল্টে দিল—গ্রুপ চ্যাটিং ও ভিডিও কনফারেন্স। সামাজিকতার নতুন মাধ্যম হয়ে উঠল, 'সোশ্যাল মিডিয়া'। অনেক হারানো বন্ধু ও পুরনো বন্ধুকে নামে এবং ছবিতে চিনে নিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল ফেসবুকের দৌলতে। যারা কোনদিন বন্ধু ছিলেন না, যাঁদের সঙ্গে কোনদিন আলাপ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না, যে সেলিব্রেটিদের ধারেকাছে যাওয়া যেত না--তাঁরাও আবেদন জানিয়ে বা আবেদনে সাড়া দিয়ে বন্ধু হয়ে উঠলেন ফেসবুকে। বন্ধুত্বের নতুন নাম হল, 'ফেসবুক ফ্রেণ্ড'। নিত্যদিনের 'লাইক', 'কমেন্ট', 'চ্যাট', 'শেয়ার'-এ তাঁদের সঙ্গে গড়ে উঠল নিত্য যোগাযোগ। এই বন্ধুত্বেও আড্ডা রইল, চটুল মন্তব্য রইল, অপেক্ষা রইল, উপেক্ষা রইল, শ্লেষ রইল, আশ্লেষ রইল, আশ্বাস রইল, আহ্বান রইল, সৃজন রইল, সঙ্গ রইল। আসলে, বন্ধুত্বসূত্র কখনোই হারিয়ে যায় না, আবেগে-অনুভবে চিরকাল থেকে যায়, শুধু সময়ের প্রয়োজনে মাধ্যমটা বদলে যায়। আর বন্ধুত্বের সেই মাধ্যম থেকেই রচিত হয় নিত্যনতুন বন্ধুনাম। মহাকালের হালখাতায় এটাই শাশ্বত নিয়ম...