গঙ্গা আর পদ্মা পাড়ের লোক-ঐতিহ্যে সেই কবেকার এক প্রাচীন রীতি ছিল মেয়েতে মেয়েতে ‘সই’ পাতানো। এই পাতানো মিতালিতে দু'জনের মধ্যে আবার নাম ধরে ডাকার নিয়ম নেই। কোথাও কোথাও শুধু ‘সই’ বলেই একে-অপরকে ডাকার রীতি, কোথাও আবার ‘সই’দের হরেকরকম নাম—‘লবঙ্গ ফুল’, ‘গোলাপ ফুল’, ‘বকুল ফুল’, ‘বেলি ফুল’ আরও কত কী! ‘লবঙ্গফুল’-নামটা আমি জেনেছি বিভূতি বাঁড়ুজ্যের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর পদ্মঝির কাছ থেকে, তার এ-নামে এক সই ছিল। আর বিনোদিনী দাসী অর্থাৎ নটি বিনোদিনীর লেখা 'আমার কথা' আত্মজীবনীতে পেলাম 'গোলাপ ফুল'-এর কথা। সেখানে তিনি অসমবয়সী এক গায়িকার সঙ্গে তাঁর সই পাতানোর গল্পটি বলেছেন। আসুন, তাঁর জবানিতেই শুনি :
"যখন আমার নয় বৎসর বয়:ক্রম, সেই সময় আমাদের বাটীতে একটি গায়িকা আসিয়া বাস করেন।...তাঁহার পিতা মাতা কেহ ছিল না, আমার মাতা ও মাতামহী তাঁহাকে কন্যাসদৃশ স্নেহ করিতেন। তাঁহার নাম গঙ্গা বাইজী।...তখনকার বালিকা-সুলভ-স্বভাববশত: তাঁহার সহিত আমার 'গোলাপ ফুল' পাতান, আমরা উভয়ে উভয়কে "গোলাপ" বলিয়া ডাকিতাম...।"
'বকুল ফুল' পেলাম বাংলা সিনেমায়, "সাড়ে চুয়াত্তর" ছবিতে। ওই যে তুলসী চক্রবর্তী'র পকেটে সুচিত্রা সেনের লেখা প্রেমের চিঠি পেয়ে মলিনা দেবী যখন ভুল বুঝলেন, বুড়োর ভীমরতি হয়েছে ভেবে নিজের পোড়া কপালকে দুষতে দুষতে শয্যা নিলেন; তখন সেই যে সান্ত্বনার স্পর্শ নিয়ে এলেন মলিনার সই, বিছানার পাশে এসে সম্বোধন করলেন, 'বকুল ফুল!' মনে পড়ছে?
ছোটবেলার সেই ‘এলাটিং বেলাটিং’ খেলার কথা মনে আছে? ঐ যে একদল এ-ওর কাঁধে হাত রেখে :
‘এলাটিং বেলাটিং সই লো,
কিসের খবর পাই লো?’
—ছড়া কাটতে কাটতে আরেক দলের কাছে এগিয়ে আসত? এবার মনে পড়েছে, তাই না? তো, এ খেলার ছড়ায় সম্বোধনে দেখুন কেমন একটি মজার সইনাম পেয়ে গেলাম—‘এলাটিং বেলাটিং’। এভাবেই আমাদের লোকসংস্কৃতি বুকের মধ্যে ধরে রেখেছে বদলে যাওয়া বাঙালির ফেলে আসা ঐতিহ্যের ইতিহাস।
আসলে, ‘সই’য়েরা এমনই এক অন্তরঙ্গ-একান্ত বন্ধু যে, তাদের কাছে হৃদয় খুলে কথা বলা যায়, সুখ–দুঃখ ভাগ করে নেওয়া যায়, বিপদে-আপদে তাদের সব সময় পাশে পাওয়া যায়। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘মহুয়া’ পালায় পালং সই বা পালঙ্ক সইয়ের কথা ভাবুন, মহুয়ার ভালবাসায়, তার বিপদের দিনে সে তার পাশে পাশে সব সময় থেকেছে। এমনকি যখন মহুয়া মারা গেল, তখনও সে তার কবরের পাশটিতে বসে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছে। রাধার জীবনে উঁকি দিলেও দেখতে পাই, রাধার পূর্বরাগ-অভিসার-বিরহের সবটা জুড়ে রয়েছে তাঁর সইয়েরা। সইয়েরা আছেন রূপকথার গল্পে, এমনকি ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর দেশেও।
সই পেলাম, সইনামও পেলাম; কিন্তু, কথা হচ্ছে যে, সেকালে 'সই' পাতানো হত কেমন করে? মানে বলতে চাইছি যে, তার আচার-আয়োজন-অনুষ্ঠানই বা ছিল কেমন? লোকসংস্কৃতির পরত উল্টে সেই খোঁজ করতে গিয়েই আশুতোষ ভট্টাচার্য সংগৃহীত লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারে পেয়ে গেলাম একটি 'সহেলা' বা 'সই পাতানোর গান'। সেখানে দেখতে পেলাম, কমলা নামের একটি মেয়ে সই পাতাবে বলে বেরিয়েছে, সঙ্গে ডালা ভরে চিঁড়ে-গুড়-কলা-চিনি নিয়েছে আর নিয়েছে বাটাভরা পান-সুপারি, সাজি ভরা ফুল-দুব্বো :
‘চলিলা কমলা গো-সহেলা পাতিবারে ।
চিড়া-গুড় লৈল কমলা, ডাইলারে ভরিয়া।।
কলা চিনি লৈল কমলা, ডাইলারে ভরিয়া।
পান শুবারী লৈল কমলা, বাটারে ভরিয়া।।
পুষ্প দূর্বা লৈল কমলা, সাজিরে ভরিয়া।’
এ তো শুধু সই পাতানোর যে আয়োজন, তার বর্ণনা। কিন্তু, আচারটা কী? অবশেষে সেও পেয়ে গেলাম কেতকাদাসের ‘মনসা-মঙ্গল’ কাব্যে। সেখানে আবার কমলা নামের এক এয়োর সঙ্গে সই পাতাবেন বলে দেবী মনসা চলছেন ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে। তিনি পাটের শাড়ি পরেছেন, সিঁথায় সিঁদুর দিয়ে ভারির কাঁধে আখন্ড কলার কাঁদি চাপিয়ে সঙ্গে নিয়েছেন হলুদ, আমলা, সুগন্ধী, পাথি ভরা খই, তার ওপরে দই সাজিয়ে পান সুপুরি আর সোনার কৌটোয় সিঁদুরও নিয়েছেন। শঙ্খিনী নগরে পৌঁছে কমলার কাছে গিয়ে তাকে সই পাতানোর কথা বলতেই:
‘কমলা হরিষ হয়্যা নিজ পরিজন লয়্যা
সয়লা করিল দুইজনে।
হেটে খই উভে দৈ প্রাণপ্রিয় তুমি সই
ইহ বলি দিল আলিঙ্গনে।।
ঘন ঘন হুলাহুলি সই সই কোলাকুলি
দুই সই বদলিল মালা।’
মধ্যযুগের প্রায় সমস্ত কবির লেখা মনসামঙ্গলেই একটু এদিক-ওদিক করে গুণিনের স্ত্রীর সঙ্গে দেবী মনসার ‘সয়লা’র প্রচলিত আচারের বর্ণনা আছে। সই পাতাতে গিয়ে এই যে ‘হেটে খই উভে দৈ/ প্রাণপ্রিয় তুমি সই’ বলে জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্বের শপথ নেওয়ার প্রথা, একে বলা হত, ‘সয়লা’। তবে, মনসামঙ্গলের যুগ পেরিয়ে ‘সয়লা’র এই শপথ উনিশ শতকে এসে অন্তরের গান হয়ে উঠেছিল -
‘সই লো সই মনের কথা কই
জীবনে মরনে যেন এক হয়ে রই।’
রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে জীবনে-মরণে এক হয়ে থাকবে বলে বিনোদিনী আর আশালতা নিজেদের মধ্যে সই পাতিয়েছিল, তারা এই ‘সই’-সম্পর্কের নাম দিয়েছিল, ‘চোখের বালি’। আপনারা জানেন, নিছক গল্পের প্রয়োজনেই এমন নামের মিতালি; সমাজে কেউ এ নামে সই পাতায় না।
গল্পের কথাই যখন উঠল, তখন বলি, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসে সেই রক্তবতী মশা আর কঙ্কাবতীর মধ্যে সই পাতানোর কথা। তাদের সই-সম্পর্কের নাম, ‘পচাজল’। মশাদের তো পচাজল খুব প্রিয়, তাই অভাগিনী কঙ্কাবতীর সঙ্গে আলাপ হয়ে মশাদের রাজকন্যা রক্তবতীর যখন খুব ভালো লেগে গেল, তখন সে তার প্রিয় জিনিসের নামেই সই পাতাতে চাইল। সে কঙ্কাবতীকে বলল :
“...এখন এস ভাই! কিছু একটা পাতাই।... তোমার সহিত আমি ‘পচাজল’ পাতাইব। তুমি আমার ‘পচাজল’, আমি তোমার ‘পচাজল’! কেমন! এখন মনের মতো হইয়াছে তো?’’
রক্তবতীর মতো কেউ ‘পচাজল’ নামে সই আমাদের সমাজে কেউ পাতায়নি ঠিকই, তবে সে ‘মনের মতো’ হওয়ার যে কথাটি বলেছে, সে বড় খাঁটি কথা। মনের সঙ্গে মন মিললে তবেই তো ‘সই’ পাতানোর কথা ভাবা, তারপর খুঁজে নেওয়ার পালা মনের মতো একটি সই-নাম। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘রসকলি’ গল্পে, এমনই এক নতুন সই-নাম ‘রসকলি’র হদিশ দিয়েছেন। গল্পে, মঞ্জরী আর গোপিনীর ‘রসকলি’ পাতানোর একটি সুন্দর বর্ণনাও আছে :
“মঞ্জরী বলিল, তা ভাই অনুষ্ঠানটা হয়ে যাক, তুমি আমার নাকে ‘রসকলি’ এঁকে দাও, আমি তোমার দিই,--যা নিয়ম তা তো করতে হবে।–বলিয়াই খুঁজিয়া পাতিয়া সব সরঞ্জাম বাহির করিয়া তিলকমাটি ঘষিতে বসিল।
“তারপর গোপিনীর কোল ঘেঁষিয়া কহিল, ...আগে তোমার পালা। দাও, আমার নাকে রসকলি এঁকে দাও।–বলিয়া নিজের আঁকা রাসকলিটি মুছিয়া ফেলিল।
“...গোপিনী...মঞ্জরীর নাকে রসকলি আঁকিয়া দিল”।
আমাদের সমাজে মেয়েতে মেয়েতে যেমন ‘সই’ পাতানো হত, তেমনি ছেলেদের মধ্যে পাতানো হত ‘মিতা’। এবং, সেই বন্ধু-সম্পর্ক কেমন করে পাতানো হত ‘কেয়াপাতার নৌকো- প্রথম পর্ব’ উপন্যাসে প্রফুল্ল রায় তার একটি সুন্দর ছবি এঁকেছেন :
“মজিদ মিঞা বলল, ‘...আমার সাধ আপনের লগে মিতা পাতাই।’
অবনীমোহন সবটা বুঝতে পারেন নি, অনুমানে ভর করে বললেন, ‘বন্ধুত্ব করতে চাইছেন?’
‘হ।’ করুণ মিনতিপূর্ণ চোখে এমনভাবে মজিদ মিঞা তাকাল যাতে মনে হয়, অবনীমোহনের বন্ধুত্ব না পেলে তার জীবন নিষ্ফল হয়ে যাবে। অবনীমোহনের একটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-র ওপর তার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।
প্রৌঢ় মানুষটির শিশুর মতো আচরণ, সরলতা, বন্ধুত্বের জন্য কাঙালপনা, সব একাকার হয়ে অবনীমোহনকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। বললেন, ‘আপনি বন্ধু হতে চাইছেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।’
‘মিতা হইবেন, কথা দিলেন কিলাম (কিন্তু)—’
‘হ্যাঁ।’
‘পাকা কথা।’
‘পাকা কথা বৈকি।’ অবনীমোহন হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন।
‘এইর লেইগাই কিন্তুক কেতুগঞ্জ থিকা অ্যাতখানি পথ এই রাইতে আইছি।’
শুধুমাত্র তাঁর বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষায় একটি মানুষ এত রাতে এতটা পথ চলে এসেছে, যতবার ভাবলেন ততবারই অবাক হয়ে গেলেন অবনীমোহন।”—
সময়টা উনিশ শ’ চল্লিশের অক্টোবর, কলকাতার বছর পঞ্চাশের অবনীমোহন পুব বাংলার রাজদিয়াতে সপরিবারে এসেছেন মামাশ্বশুর হেমনাথের বাড়ি বেড়াতে। এলাকার মানুষ হেমনাথকে খুব মান্যিগন্যি করে। তাঁরই সালিশীতে যেদিন নবু গাজীর সঙ্গে মজিদ মিঞার চার বছরের পুরনো কাজিয়া মিটে গেল, সেদিনই অবনীমোহন রাজদিয়াতে পা রেখেছেন। মজিদের মনে হয়েছে, অবনীমোহন এসেছে বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। সুদূর কেতুগঞ্জ থেকে সে নৌকো বেয়ে এসেছে তিন হাঁড়ি মিষ্টি আর মাছ নিয়ে শুধু অবনীমোহনের সঙ্গে ‘মিতে’ পাতাতে। রাতে দুজনে পাশাপাশি বসে খেয়ে পাকা করেছে সেই সম্পর্ক। এমন সম্পর্কে বয়স কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, বাধা হয়নি জাতপাত।
এই যে বন্ধুত্বের হরেক নাম, তার কিন্তু একটাই অভিঘাত, প্রেম-ভালোবাসা-বিশ্বাস ও বন্ধনের মধ্য দিয়ে মানুষে-মানুষে জাতিতে-জাতিতে মহামিলন—দুটো রক্তসম্পর্কহীন মানুষের মধ্যে বিয়ে-সাদির মতোই একটি প্রবহমান সম্পর্কের বীজ বুনে দেওয়া। তাই কি, এই বন্ধুত্ব পাতানোর মধ্যে বিয়ের আচারের মতোই সম্পর্ক নির্মাণের আনুষ্ঠানিক আচার থাকে? তাই কি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার একে-অপরকে নাম-না-ধরে ‘হ্যাঁ গো’, ‘ও গো’-বলে প্রাচীন সম্বোধনের আদলে এই পাতানো বন্ধুত্বেও শুধু বন্ধুত্বের নাম ধরে ডাকার রীতি? হবেও বা। আসলে, বাঙালির আবহমান বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির এও একটি অপরূপ রূপ।