বিপ্লবের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া দেশসেবক

১৯২১ সাল। দেশ তখন উত্তাল। ব্রিটিশ শৃংখল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিপ্লবীরা। নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। বিভিন্ন জায়গায় বিদেশি জিনিস বর্জনের আন্দোলন চলছে। দেশের বাতাসে তখন শুধুই লড়াইয়ের গন্ধ।

 

সেদিন সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে একদল যুবক কলকাতার এক কাপড়ের দোকানের সামনে নিজেদের সভা আয়োজন করেছিল। পুলিশের কাছে খবর ছিল আগেই। সেদিন গ্রেপ্তার হলেন অনেক যুবক। তাদের মধ্যে ছিলেন এক কিশোর। চোখে চশমা। চশমার ওপারে চোখ দুটোয় শুধুই বিপ্লব। মাথা না নোয়ানোর জেদ। আত্মমর্যাদায় ভরপুর। যতীন্দ্রনাথ দাস। বিপ্লবের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া এক দেশপ্রেমিক।

 

১৯০৪ সালের ২৭শে অক্টোবর জন্ম এই কলকাতার বুকে। বাবা বঙ্কিম বিহারী দাস, মা সুহাসিনী দেবী। দেশপ্রেমের চিন্তা পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন। কৈশোরে যোগদান করেছিলেন অনুশীলন সমিতিতে। প্রথমদিকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের শরিক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ দাস। পরে ইংরেজদের অত্যাচার দেখে তাঁর চিন্তা-ভাবনা বদলে যায়। সহিংস বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্র হিসেবেও সুনাম ছিল তাঁর। তবে দেশসেবাই ছিল জীবনের ব্রত।

 

প্রথমবার গ্রেপ্তার হয়েই যতীন দাসের মনে হয়েছিল জেলে কেন রাজবন্দীর সম্মান দেওয়া হবে না বিপ্লবীদের? আন্দোলন করার কথা চিন্তা-ভাবনাও করছিলেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই যতীন দাস সহ আরো যুবকরা ছাড়া পেয়ে যান। তবে সেই সময় থেকেই রয়ে যায় আন্দোলনের চিন্তা।

Jatindranath1

বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র তখন যতীন্দ্রনাথ দাস। তাঁকে গ্রেফতার করে পাঠানো হলো ময়মনসিংহে। সেখানেও তিনি দেখলেন রাজবন্দিদের ওপর অত্যাচার। ময়লা জামাকাপড়, অস্বাস্থ্যকর খাবার ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবাদ করলেন যতীন্দ্রনাথ দাস। সেভাবে সুফল মিলল না। প্রথমবার যতীন দাস শুরু করলেন অনশন। কোনও বিপ্লবী এই প্রথম এতটা সাহস দেখালেন। একসময় তাঁর জেদের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন জেলের সুপার। তিনি ক্ষমা চাইতে যতীন দাস তুলে নিলেন অনশন। জেলের খাবার, অন্যান্য ব্যবস্থার উন্নতিও হলো। এরমধ্যে কারামুক্ত হলেন যতীন দাস।

 

১৯২৯ সাল। এদিকে লালা লাজপত রাইয়ের নৃশংসস হত্যায় ক্ষেপে উঠেছিল বিপ্লবীদের দল। তাঁরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হত্যা করলেন পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্সকে। এছাড়াও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে শুরু হলো বিখ্যাত 'লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা'। ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, যতীন দাসের মতো বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার হলেন। সকলকে নিয়ে যাওয়া হল লাহোর সেন্ট্রাল জেলে।

 

লাহোর সেন্ট্রাল জেলের অবস্থা সেই সময় দুর্বিষহ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যতীন দাসকে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করলো। আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন আত্মমর্যাদাপূর্ণ এই বিপ্লবী। আরও জোরালোভাবে শুরু হল আন্দোলন। জেলের অন্যান্য বিপ্লবীরাও তাঁকে সাহচর্য দান করলেন।

 

যতীন দাস জানতেন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীদের আমরণ অনশনে ব্রিটিশ সরকার যে ভেঙ্গে পড়বেই, তা নাও হতে পারে। হয়তো এই অনশনের ফলে মৃত্যু এগিয়ে আসবে তাঁদের দিকে। একটু একটু করে আলিঙ্গন করবে। ব্রিটিশ সরকার নির্দয়ভাবে চেষ্টা করবে অনশন ভাঙার। ‌আত্মমর্যাদার প্রশ্নে পিছিয়ে যাবে না তাঁরাও। তবে সবকিছু জেনেও যতীন দাস তাঁর অনশন তুলে নেননি। শুরু হয়েছিল দীর্ঘ লড়াই।

 

অনেক বিপ্লবী অনশন তুলে নিলেও নিজের অন্তরের বোধ থেকে একচুল নড়লেন না যতীন দাস। ধীরে ধীরে দুর্বল হতে লাগল শরীর। অনেক বিপ্লবীদের জোর করে মুখে খাবার প্রবেশ করিয়ে অনশন ভাঙ্গা হয়েছিল। অদ্ভুতভাবে এটা সম্ভব হয়নি যতীন দাস এর ক্ষেত্রে। একসময় গলা থেকে আওয়াজ বেরলো বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আত্মা তখনও জেগে। দধীচির মত। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর সদস্য এই তরুণের এমন আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত স্তম্ভিত করেছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও। টানা ৬৩ দিন অনশন।

 

প্রথমবার তাঁর অনশনের চোদ্দ দিন পরে এক ডাক্তার এসেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন ওষুধ দেওয়ার। গ্রহণ করেননি যতীন দাস। সেই ডাক্তার যখন প্রশ্ন করেছিলেন ''সামান্য খাদ্য গ্রহণ না করেও কিভাবে বেঁচে আছেন আপনি?''। যতীন দাসের মুখে তখন স্মিত হাসি। উত্তর দিয়েছিলেন ''ইচ্ছেশক্তির জোরে''। আর চেষ্টা করেননি সেই ডাক্তার।

 

বেশ কিছুদিন পরেও আর একজন ডাক্তার এসেছিলেন। খাবার, ওষুধ দুইয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে বার আর কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না যতীন দাস। অবশেষে ১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে অনেক দূরের দেশে পাড়ি দেন এই বিপ্লবী।

 

তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। জনসমুদ্র নেমেছিল সেদিন রাস্তায়। পুরোভাগে ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যতীন দাসের বাবা সেদিন হাঁটু মুড়ে ছেলের মৃতদেহের সামনে আকুতি জানিয়েছিলেন ঈশ্বরকে। ‌নিজের সন্তানকে দেশের জন্য বলিদানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেদিন বিপ্লবের সংজ্ঞা নতুন করে আবিষ্কার করেছিল দেশ। আত্মমর্যাদাপূর্ণ বিপ্লবের সেই প্রতিধ্বনি আকাশে, বাতাসে পাক খেয়ে বেড়িয়েছিল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...