দুর্গাপূজা তো প্রায় এসেই গেল। আর পুজো মানেই নতুন জামাকাপড় সঙ্গে মনপসন্দ গয়নাগাটি আরও অনেক কিছু কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়ার পর্ব। আর কেনাকাটা আর খাওয়া দাওয়া বললেই কলকাতার বাঙালির সাবেক পছন্দ নিউ মার্কেট। কিন্তু জানেন কি এই জমজমাট নিউমার্কেটেরই পাশের রাস্তা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট বা অধুনা মির্জা গালিব স্ট্রিট একসময় ছিল বাঁশের জঙ্গল?
আচ্ছা, এতবড় বাজার সংলগ্ন রা্স্তার নাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিট কেন? উত্তর টা খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রায় আড়াইশো বছর আগের কলকাতার দিকে। আজকের কলকাতার অনেক জনবহুল জায়গা তখন ছিল ঝোপ জঙ্গলে ভরা। সেরকমই এক জায়গা ছিল এই মির্জা গালিব স্ট্রিট। বণিকের মানদণ্ড কে রাজদন্ডে পরিণত করতে হলে এদেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, শিখতে হবে এই দেশের স্থানীয় রীতি-নীতি, আচার ব্যবহার আর সর্বোপরি ভাষা। এই অমোঘ সত্যি টা বুঝতে চতুর ব্রিটিশদের খুব বেশি দিন লাগেনি। আর সেই উদ্দেশ্যেই অর্থাৎ ইংল্যান্ড থেকে আগত ব্রিটিশদের এইদেশের ভাষা, রীতি-নীতি শেখানোর উদ্দেশ্যেই বাঁশের জঙ্গল কেটে তৈরি করা হয় এক অবৈতনিক বিদ্যালয় বা ফ্রি স্কুল, যেখানে শুধুমাত্র ব্রিটিশদের সন্তানরাই শিক্ষালাভ করতে পারবে। আর তার ফলে স্কুল সংলগ্ন রাস্তাটির নাম হয় ফ্রি স্কুল স্ট্রিট।
এই ফ্রি স্কুল ঠিক কবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। একটি মত অনুযায়ী, ওল্ড ক্যালকাটা চ্যারিটি প্রদত্ত অর্থে, ফ্রি স্কুল সোসাইটির সহযোগিতায় ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে এই অবৈতনিক বিদ্যালয়টি শুরু হয়। আবার তৎকালীন বাংলা সিভিল সার্ভিসের সদস্য মি. এ.কে. রায় সংগৃহীত সেন্সাস অব ইন্ডিয়ায় বলা হয়েছে-
"About the year 1760 a school was founded for the education of East Indian and European girls, by one Mrs. Hodges, who taught dancing and French exclusively. A charity school for Eurasian boys (the free School) was first set up about 1727 by Mr. Bourcheir, a merchant, who was afterwards appointed Governor of Bombay. In 1765 the school enlarged to a great extent by private subscriptions, in consideration of which the Government agreed to subscribe Rs. 800 per mensem towards its maintenance."
ধর্মযাজক বিশপ টার্নার এই স্কুলটিকে খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের দ্বারা পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তাঁর উদ্যোগেই স্কুল লাগোয়া ফ্রি স্কুল চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শুধু স্কুল নয়, এই পথ জুড়ে রয়েছে আরও অনেক ইতিহাস। ফ্রি স্কুল বিল্ডিং তৈরির আগে এখানেই বসবাস করতেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিশিষ্ট বিচারক মি. লিমেরিক। তিনি ছিলেন মহারাজা নন্দকুমার মামলার এক অন্যতম বিচারক, জানা যায়, তাঁর রায়েই কারাবন্দী হয়েছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। এই পথেরই ৩৯ নম্বর বাড়িতে ১৮৪৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত ইংরেজি ঔপন্যাসিক উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে। তাঁর বাবা রিচমন্ড থ্যাকারে ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অফ রেভেনিউ এর সেক্রেটারি ও চব্বিশ পরগনার কালেক্টর। পরে অবশ্য তাঁরা বাসস্হান পরিবর্তন করে আলিপুরে চলে যান ও সেই ৩৯ নম্বর বাড়িটি হয়ে যায় আর্মেনিয়াম কলেজ।
সাহেবিয়ানায় ভরা এই রাস্তার ওপরেই স্থাপিত হয়েছিল আরও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্য পেরেন্টাল অ্যাকাডেমি ইনস্টিটিউশন। বিদেশীরা এই দেশের ভাষা শিক্ষার ওপর কতটা জোর দিয়েছিল তারই প্রমাণ এই রাস্তার সাবেক ইতিহাস। এছাড়াও বিনোদনের জন্য ছিল জার্মান ক্লাব। এই ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল-
"To offer to the German Community of Calcutta a place of recreation, where German Music, Gymnastics, Theatrical and the Amenities of Social Life."
১৮৭৬ সালে এই রাস্তা পরিবর্ধিত হয় ধর্মতলা স্ট্রিট পর্যন্ত। একদিকে পার্কস্ট্রিট অন্যদিকে ধর্মতলা স্ট্রিটের সংযোগকারী রাস্তা এই ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। মির্জা গালিবের কলকাতা বাসের ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৬৯ সালে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মির্জা গালিব স্ট্রিট। বর্তমানে এই রাস্তাতেই আছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য বিভাগের হেড অফিস ও কলকাতা ফায়ার ব্রিগেডের হেড কোয়ার্টার। এছাড়াও আছে দেশি বিদেশি প্রচুর খাবারের দোকান।
১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। তাই ঔপনিবেশিক শাসকেরা তাদের মনের মত করে গড়ে তুলেছিল তাদের উপনিবেশের এই অংশটিকে। আর তাই, কলকাতার আনাচে কানাচে আজও ছড়িয়ে আছে সাবেক সাহেবিয়ানার চিহ্ন। পুরোনো বইয়ের দোকান, রেকর্ডের দোকান, রকমারি বিদেশি জিনিসের দোকান, হস্তশিল্পের সম্ভার প্রভৃতি নিয়ে এই পথ আজও বহন করে চলেছে সেকালের সাহেবি কলকাতার সাক্ষ্য।
নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু