ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ সবেমাত্র আস্বাদন করতে শুরু করেছে ভারত। কিন্তু স্বাধীনতা পেলেই তো হলো না - তা বজায় রাখতে প্রয়োজন এক নতুন সংবিধান। আম্বেদকরের দায়িত্বে তার খসড়া সম্পূর্ণ হলো বটে কিন্তু এমন ঐতিহ্যশালী দেশের সংবিধান ও তার গঠন, নকশা সে তো আর মুখের কথা নয়! আম্বেদকরের সাথে যুক্ত হলেন আরো তিন স্তম্ভ, যার মধ্যেই দুজন সেভাবে শ্রুত নয়। আজ সেই তথ্য দেব।
স্থির হয় হাতে লেখা হবে গোটা সংবিধান। শুধু তাই নয়, সেই হাতে লেখা পৃষ্ঠার প্রতি পাতায় থাকবে দৃষ্টিনন্দনকারী শিল্পের সমাহার। এ এক মহামূল্যবান দেশের সম্পদ, তার দৃষ্টিনান্দনিকতার প্রয়োজন আছে বই কি!
এই কঠিন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হলো দিল্লির বাসিন্দা সুদক্ষ ক্যালিগ্রাফার প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা-কে (সাক্সেনা)। তিনি ব্রিজবিহারী নারায়ণ রায়জাদা-র পুত্র। আরো আশ্চর্যের এই কাজটি করতে জওহরলাল নেহেরু তাঁকে পারিশ্রমিক প্রদানের কথা জানালে তিনি তা না নিয়ে, শুধু একটি আবদার করেছিলেন - তা হলো সংবিধানের প্রতি পাতায় তিনি নিজের নাম লিখবেন এবং শেষ পাতায় তাঁর নামের সাথে থাকবে তাঁর ঠাকুরদার নাম। এই আবদার নেহেরু ফেরাতে পারেন নি। দীর্ঘ ৬ মাস ব্যাপী পার্লামেন্টের কনস্টিটিউশন হলে( যা এখন কস্টিটিউশন ক্লাব নাম পরিচিত) বসে ৩৯৫ আর্টিকেল, ৮ শিডিউল এবং ১ টি প্রি - এম্বল হাতে লেখেন তিনি। এ কাজে ৪৩২ টি পেনের নিব ব্যবহৃত হয়েছিল ( যা আজও সংরক্ষিত)। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞে তাঁর অবদানের বৃত্তান্ত জানেন কজন!! এতো গেল লেখার কথা।
কিন্তু হাতের লেখার পাশাপাশি ছবি ও নকশা দিয়ে সংবিধানের পাতাগুলিকে সাজানোর বিষয়ে শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু ছাড়া আর কারোর কথাই ভাবা হয় নি। কারণ নন্দলাল বসু এর আগেও নানান কাজে নিজ দক্ষতার নিদর্শন রাখেন। ১৯৩৫-৩৭ সালে পর পর তিন বছর তিনি কংগ্রসের বার্ষিক সম্মেলনে শিল্প প্রদর্শনী ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তোলে। তাই তাঁর থেকে যোগ্য ব্যক্তিত্ব এই সংবিধানের সচিত্র সংস্করণের কাজে পাওয়া খানিক দুর্লভ ছিল।
শান্তিনিকেতনে এ খবর তাঁর কাছে যাওয়া মাত্রই এক অভিনব দায়িত্ব পেয়ে তাঁর তৎপরতাও ছিল দেখার মতো। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের সংবিধানের অলঙ্করণের কাজ সম্পন্ন করেন জব্বলপুরের বাসিন্দা চিত্রশিল্পী রাম মনোহর সিনহা। পুরো সংবিধানটি ছাপা হয় ফোটো লিথোগ্রাফ পদ্ধতিতে, দেরাদুনের সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে।
এমন নকশামণ্ডিত সংবিধানের পৃষ্ঠা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যে যে বিষয় নিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে সেগুলি এক্কেবারে ভারতের নিজস্ব- ঐতিহ্যের ছবি। তা হল - মহেঞ্জোদারের সিল, গুরুকুল বা বৈদিক আশ্রমের দৃশ্য, রামায়ণের দৃশ্য, মহাভারতের দৃশ্য, বুদ্ধের জীবনী, মহাবীরের জীবনী, বৌদ্ধধর্মের প্রসার ও সম্রাট অশোকের ভূমিকা, গুপ্ত যুগের শিল্পধারার বিবিধ পর্যায়, বিক্রমাদিত্যে রাজসভা, শিবাজি ও গুরু গোবিন্দ সিং, গান্ধী ও তাঁর ডান্ডি মার্চ, গান্ধিজির নোয়াখালি ভ্রমণ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই, ভারতের বাইরে থেকে ভারত, হিমালয়ের দৃশ্য, মরুভূমির দৃশ্য, সমুদ্রের দৃশ্য। সব মিলিয়ে মোট বাইশটি ছবি।
আরও আকর্ষণীয় বিষয় হল, সংবিধানের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঁকা হয়েছে সে-পাতার ছবি। বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে, তার সঙ্গে ইতিহাস ও পুরাণের প্রসঙ্গ মিলিয়ে ভারতের সংবিধান চিত্রিত। যার যার অন্যতম অবদান নন্দলাল বসু’র। আজও মূল সবিধানটি অতি যত্নে হিলিয়াম বাক্সে পার্লামেন্টের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে ভারতের সংবিধান এই চার স্তম্ভের ঐকান্তিক প্রয়াসেই দাঁড়িয়ে আছে আজও। তা ভারতের ঐতিহ্য, সম্পদ ও গর্ব।