প্রয়াত দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির এইমসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৯২ বছরের অর্থনীতিবিদ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তাঁর মৃত্যুতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে কেন্দ্র।
হাইলাইটসঃ
১। প্রয়াত দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং
২। বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির এইমসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি
৩। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর
১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের পঞ্জাব প্রদেশে, বর্তমান পাকিস্তানের গাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনমোহন সিং৷ তাঁর বাবা অমৃত কৌর এবং মা গুরমুখ সিং। শিক্ষা এবং কর্ম জীবনও তাঁর পাণ্ডিত্যের মেধায় উজ্জ্বল। কৃতী ছাত্র, নামী শিক্ষক থেকে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে উঠে আসা— বর্ণময় তাঁর জীবন।
ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পরে ঠাকুরমার কাছেই বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় শরানার্থী হিসাবে অমৃতসরে চলে আসে তাঁর পরিবার। ১৯৪৮ সালে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের ম্যাট্রিকুলেশন পাঠ শেষ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে ওই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন। ১৯৫৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকসে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স ডিগ্রি পান।
কেমব্রিজের পর্ব সাঙ্গ করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ডি.ফিল সম্পূর্ণ করেন। ১৯৬৩ সালে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিকসের সম্মানিত অধ্যাপকের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল নাগাদ তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিকসে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের অধ্যাপকের দায়িত্ব পান।
তবে রাজনীতিতে তাঁর পথ চলা শুরু হয় ১৯৭১ সাল থেকে। এই বছরে ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রকে আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন ড. মনমোহন সিং। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর হন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে প্ল্যানিং কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালে প্রথমবার রাজ্যসভার সদস্য হন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাওয়ের অধীনে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। ভারতীয় অর্থনীতিতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানেও ভূষিত হয়েছিলেন মনমোহন সিং।
উদার অর্থনীতিকরণের মুখ্য রূপকার বলা হয় তাঁকে। কঠিন সময়ে দেশের অর্থনীতিকে নতুন করে গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মনমোহন সিং। দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিশ্বের জন্য ভারতের অর্থনীতির দ্বারকে উন্মুক্ত করেছিল।
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লোকসভায় বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব পালন করার পরে ২০০৪ সালে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৯ সালেও তিনি ফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পরপর দুবার, সব মিলিয়ে ১০ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন।
লাইসেন্স রাজের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন তিনি। লাইসেন্স দেওয়ার বা অনুমতি পাওয়ার জন্য লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকত অনেক কিছু। সেই সময় মনমোহন সিং এই লাইসেন্স রাজের সমাপ্তি ঘটান। এই সিদ্ধান্তের পরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ দেশে বেড়ে যায়। তাঁর আমলেই ভারতে বিদেশি পণ্য আমদানি অনেক সহজ হয়ে যায়। সস্তায় বিদেশী পণ্য আসা শুরু হয় দেশে। আবার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কম দামে নতুন পণ্য় তৈরি করতে শুরু করে দেশীয় সংস্থাগুলি। আয়কর ক্ষেত্রেও সংস্কার আনেন।
২০১৩ সালে দেশে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন হয়। National Food Security Act (NFSA) তৈরি করেন মনমোহন সিংহ। এই আইনের আওতায় দেশের দুই তৃতীয়াংশ লোক ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য় পাওয়া শুরু করে। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই ড. সিং এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মিলে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে ভারত-মার্কিন সিভিল পরমাণু চুক্তির জন্য ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করা হয়।
২০০৫ সালের ১৫ জুন ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার আরটিআই চালু করেছিলেন। পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষরা যাতে এইমস, আইআইটি, আইআইএম এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান, এর জন্য ২০০৬ সালে ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করেছিল। ২০০৮ সালে আইএইএ-র সঙ্গে ইন্ডিয়া-স্পেসিফিক সেফগার্ডস এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করে ভারত। এরপর ওই একই বছরে মুম্বইয়ের জঙ্গি হামলার পরে তৈরি হয় এনআইএ বা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা।
তাঁর আমলে মহাকাশ গবেষণা নতুন দিশা পায়। ২০০৮ সালে দেশের প্রথম চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ। ২০১৩ সালে মঙ্গলযানের উৎক্ষেপণও হয় মনমোহনের আমলেই। মনমোহন সিংয়ের আমলে ২০১২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে ভারতীয় অর্থনীতির ধরন বদলে দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গর্ভনর, অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ভারতের উন্নতিকরণে সারাজীবনে নীরবে নিজের ব্রত পালন করে গেছে তিনি।