রুই মাছের সাতকাহন
কথায় বলে "শাকের মধ্যে পুঁই আর মাছের মধ্যে রুই"। সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি বাঙালির খাদ্যরুচির যত পরিবর্তনই হোক না কেন আদি অকৃত্রিম রোহিত মৎস্য প্রীতিতে টান ধরেনি। বাঙালির সুখেও রুই, দুঃখেও রুই। এই মাছটি বাঙালি ঝালে ঝোলে তো বটেই এমনকি তেতো দিয়ে রেঁধে ও খেয়ে উপভোগ করে। আজকের রেসিপিতে রইল সেই একান্ত আপন মৎস্যসুন্দরীর নানান পদের বর্ণনা।
রুই মাছের তেতো চচ্চড়ি
প্রবাদ আছে ‘তিতা খেলে মিঠার লাগ পায়’। সেকালের বাঙালির খাওয়া শুরু হত তেতো দিয়ে। যদিও এই রান্নায় তেতো স্বাদ থাকলেও তা আমিষ হওয়ায় প্রথম পাতে তার আস্বাদ নিতে অনেকেই নারাজ হবেন। তবে এ রান্না এমনই মজাদার যে শুরু অথবা মধ্যে যেখানেই খাওয়া হোক না কেন তার স্বাদ কমে না। তেতো চচ্চড়ি রাঁধতে হলে রুই মাছের বাচ্চা মানে ৫/৬ ইঞ্চির পোনা হলেই ভালো।
কী কী লাগবে
রুই মাছের পোনা-৫০০ গ্রাম
করলা বা উচ্ছে-২০০ গ্রাম
আলু-২০০ গ্রাম
মেথি-ফোড়নের জন্য
তেজপাতা-ফোড়নের জন্য
শুকনো লঙ্কা- ফোড়নের জন্য
কাঁচা লঙ্কা- ৫/ ৬ টা
সর্ষে- ৫০ গ্রাম
হলুদ গুঁড়ো- ৩ বড় চামচ
নুন-স্বাদ অনুযায়ী
সর্ষের তেল-রাঁধবার জন্য
কীভাবে রাঁধবেন
পোনা মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে নিয়ে কাটতে হবে। মাছ গোটা গোটা থাকবে। মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। আলু ও করলা অথবা উচ্ছে জলে মিনিট পনেরো ভিজিয়ে রেখে চচ্চড়ির জন্য লম্বা লম্বা করে কাটতে হবে। কালো অথবা সাদা যে সর্ষে পছন্দ তা কাঁচালঙ্কা ও নুন দিয়ে মিহি করে বেটে রাখতে হবে। ২টো কাঁচা লঙ্কা বেটে নিতে হবে। গ্যাসে কড়াই বসিয়ে তাতে সর্ষের তেল দিয়ে তেল গরম হলে আলু আগে ও করলা বা উচ্ছে পরে ভেজে নিতে হবে। কড়ায় তেল কমে এলে তেল দিয়ে মাছ ভালো করে ভেজে নিতে হবে।মাছ ভাজার পরে তেল যদি থেকে যায় তবে তা ঢেলে রেখে কড়াই পরিষ্কার করে আবার তেল দিয়ে শুকনো লঙ্কা, মেথি ও তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে ভাজা আলু আর ভাজা করলা দিয়ে অল্প জল দিয়ে আলু ও করলা আধসিদ্ধ করতে হবে। এবার মাছগুলো দিয়ে হলুদ গুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা বাটা, সর্ষেবাটা আর নুন দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে অল্প জল দিতে হবে। কাঁচা লঙ্কা চিরে দিয়ে চচ্চড়ির মতো শুকনো শুকনো করে নামাতে হবে। গরম ভাতের সঙ্গে এই চচ্চড়ি? জাস্ট কোনো কথা হবে না ।
রুইমাছের ঝুরি
সাধারণতঃ মাছের পদ গরম ভাতের সঙ্গেই জমে বেশি। কিন্তু এমন কিছু ব্যতিক্রমী রুই মাছের রান্না আছে যেগুলি লুচি পরোটার সঙ্গেও দিব্বি জমে যায়। তেমনই একটি রান্না এই রুই মাছের ঝুরি।
কী কী লাগবে
বড় রুই মাছ- ১ কেজির মতো পেটির অংশ
আলু- ৩০০ গ্রাম
পেঁয়াজ-৬/৭ টা বড়
আদাবাটা-২ বড় চামচ
রসুন- পছন্দ অনুযায়ী
লঙ্কাগুঁড়ো- স্বাদ অনুযায়ী
হলুদগুঁড়ো-২ বড় চামচ
শুকনো লঙ্কা- ২ টি
কাঁচা লঙ্কা- ২ টি
নুন- স্বাদ অনুযায়ী
চিনি- সামান্য
সর্ষের তেল- রাঁধবার জন্য
কীভাবে রাঁধবেন
আলুগুলো ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। মাছ ধুয়ে নিয়ে কাটার পর আবার ভালো করে ধুতে হবে। মনে রাখতে হবে মাছ ধুতে ধুতে যতক্ষণ না জলের রং স্বাভাবিক হচ্ছে ততক্ষণ অবধি মাছ ধুতে হবে। প্রবাদও আছে, মাছ ধুলে মিঠা। মাছ ধোওয়া হয়ে গেলে মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। পেঁয়াজগুলো খুব সরু সরু করে কেটে রাখতে হবে। গ্যাসে কড়া বসিয়ে তাতে একটু বেশি করে সরষের তেল দিয়ে অন্ততঃ ৪টে পেঁয়াজকুচি অল্প অল্প করে দিয়ে মচমচে করে ভেজে তুলতে হবে। সেদ্ধ করে রাখা আলুর খোসা ছাড়িয়ে সরু সরু লম্বা লম্বা করে কেটে রাখতে হবে। কড়ায় তেল কমে এলে আবার তেল দিয়ে আলুগুলো ভালো করে ভেজে তুলতে হবে। শুকনো লঙ্কা কুচি কুচি করে তেলে ভাজতে হবে। ওই শুকনো লঙ্কা ভাজার ওপর রসুনকুচি দিয়ে একটু ভাজা ভাজা করে পেঁয়াজকুচি দিয়ে ভাজতে হবে। পেঁয়াজ ভাজা নরম থাকবে কিন্তু কাঁচা ভাবটা থাকবে না। এবার লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, আদাবাটা দিয়ে ভালোভাবে কষিয়ে মাছগুলো মশলায় দিয়ে খুন্তি দিয়ে মাছ ভেঙে দিতে হবে।এই সময় আলু ভাজা, কাঁচা লঙ্কাকুচি ও পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে আলগা আলগা ভাবে নাড়তে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে দলা না হয়ে যায়। বেশি শুকিয়ে গেলে অল্প গরম জল দিয়ে নাড়তে হবে। বেশ ঝুরঝুরে হলে গরমমশলাগুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে রেখে রাখতে হবে। পরিবেশনের সময় হাত দিয়ে মাছের কাঁটাগুলো বার করে নিতে হবে। এই রান্নাটি সেকালের একটি "বোনলেস" পদ যা গরম ভাত, পোলাও থেকে লুচি, রুটি সবেতেই লা-জবাব ।
রুই মাছের ভাপা
কী কী লাগবে
বড় রুইমাছ- ১ টি
টক দই– ২৫০ গ্রাম
ঘি- ২০০গ্রাম
গোটা গরম মশলা – ফোড়নের জন্য
গরম মশলা গুঁড়ো– মাছের পরিমাণ অনুযায়ী
লঙ্কা গুঁড়ো– স্বাদ অনুযায়ী
আদাবাটা- ২ চামচ
পেঁয়াজবাটা- ২/৩ টে বড় পেঁয়াজ
সর্ষের তেল- রাঁধবার জন্য আন্দাজ মতো
কাঁচালঙ্কা- ২/৩টে
চিনি- স্বাদ অনুযায়ী
নুন- স্বাদ অনুযায়ী
কীভাবে রাঁধবেন
রুই মাছের ভাবা দু’ভাবে রান্না করা যায়। পেঁয়াজ দিয়ে বা না দিয়ে।পেঁয়াজ যাদের পছন্দের তালিকায় নেই তাদের জন্য রইল এই রান্নার অন্য পদ্ধতি।
পেঁয়াজ দিয়ে রান্না
এই রান্নার জন্য বড় রুই, যাকে বলা হয় পাকা রুই সেরকম মাছ লাগে। মাছ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে বড় বড় টুকরো করতে হবে। টক দই ভালো ভাবে ফেটিয়ে নিতে হবে। মাছের টুকরোগুলো আবার ধুয়ে নিয়ে টক দইতে অন্ততঃ এক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। আদা খোসা ছাড়িয়ে ধুয়ে নিয়ে মিহি করে বাটতে হবে। আদায় ছিবড়ে থাকলে ফেলে দিতে হবে। পেঁয়াজগুলোর খোসা ছাড়িয়ে ধুয়ে নিয়ে মিহি করে বেটে নিতে হবে।
এই রান্নাটি ঘি দিয়েই করার কথা কিন্তু আজকাল শারীরিক কারণে অনেকে ঘি খান না বলে ঘি ও সর্ষের তেল মিশিয়ে রাঁধলেও হবে। কড়াই গরম করে তাতে ঘি ও সর্ষের তেল মিশিয়ে নিতে হবে। ঘিয়ের পরিমাণ তেলের চেয়ে বেশি হলে স্বাদ ভালো হবে। মিশ্রণটি গরম হলে গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজবাটা, আদাবাটা, লঙ্কাগুঁড়ো ও চিনি দিয়ে ভালো করে কষাতে হবে। অল্প অল্প করে জল দিয়ে খুন্তি দিয়ে মশলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মিশিয়ে কষাতে হবে।না হলে পেঁয়াজের কাঁচা গন্ধ যাবে না। মশলা থেকে তেল গড়িয়ে এলে দইতে ভেজানো মাছগুলোকে সাবধানে কড়ায় সাজিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট দই টাও ঢেলে দিতে হবে। নুন আর কাঁচালঙ্কা দিতে হবে। দই আর মশলা মেশাবার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে মাছগুলো ভেঙে না যায়। এবার কড়াই ঢাকা দিয়ে আঁচ একটু কমিয়ে মিনিট পাঁচেক রেখে ঢাকা তুলে অল্প জল দিয়ে ফুটিয়ে গা মাখা ঝোল হলে নামিয়ে ঘি ও গরমমশলাগুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই তৈরি রুই মাছের ভাবা।
পেঁয়াজ ছাড়া রান্না
পেঁয়াজ যারা পছন্দ করেন না বা কোনও কারণে পেঁয়াজ খান না তারা এই পদটি রাঁধতে হলে হিং, জিরেগুঁড়ো ও ধনেগুঁড়ো ব্যবহার করতে পারেন। অন্যান্য উপকরণ একই থাকবে। রান্না করার সময় হিং ফোড়ন দিয়ে আদাবাটা, লঙ্কাগুঁড়ো,ধনেগুঁড়ো(২ চামচ), জিরেগুঁড়ো(১ চা চামচ)ও চিনি দিয়ে, অল্প অল্প জল দিয়ে কষাতে হবে। মশলা থেকে তেল ছাড়লে দইসহ মাছগুলো দিয়ে প্রথম পদ্ধতির মতোই বাকি রান্না করতে হবে।