হারিয়ে যাওয়া মাছ
আজ মহালয়া। পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার দিন। যাদের হাতে গড়ে উঠেছে বাংলার এক নিজস্ব রন্ধনধারা, সেই সব অসামান্যা রন্ধনশিল্পীদের জন্য আমাদের তর্পণ-তাঁদের শিল্পকর্মের ধারাকে প্রবাহিত রাখা।নাম-না-জানা যেসব রন্ধনপটিয়সীর ছোঁয়ায় দৈনন্দিনের তুচ্ছ পদেও লাগত আশ্চর্য স্বাদ, হারিয়ে যাওয়া সেই প্রতিভাময়ীদের স্মরণে আজকের রেসিপি-হারিয়ে যাওয়া মাছ।
চই কই
“চই কচু আর বড়ি দিয়ে কই মাছের ঝোল রাঁধতে পারো?”- কমলা দেবীকে এ প্রশ্ন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির প্রায় সব বউরা ছিলেন যশোরের মেয়ে। সেই সূত্রেই হয়তো কবির পরিচয় ছিল চই-এর সঙ্গে। যশোর-খুলনা অঞ্চলে চই পাওয়া যায়। বড় গাছের গায়ে লতিয়ে ওঠা এই উদ্ভিদের স্বাদে নিজস্বতা আছে। আছে নানান ভেষজ গুণও। ঝাল তো লঙ্কাতেও হয়। চই, ঝাল স্বাদের হয়েও কোথায় আলাদা তা জানতে হলে রাঁধতে হবে চই কই। রবীন্দ্রনাথের চেনা সেই রান্নার রেসিপি রইল এই লেখায়। শহর কলকাতায় চই-এর খোঁজ পেতে পারেন কোলে মার্কেটে।
কী কী লাগবে
কই মাছ-৬টা
বিউলির ডালের বড়ি-৮টা( বড়)
চই-৬-৭ টা টুকরো
হলুদ গুঁড়ো-৩ চামচ
জিরে গুঁড়ো-২ চা চামচ
ধনে গুঁড়ো-২ চা চামচ
আদাবাটা-২ চা চামচ
গোটা জিরে-ফোড়নের জন্য
তেজপাতা-ফোড়নের জন্য
চই-৭-৮টা টুকরো
সর্ষের তেল-প্রয়োজনমতো
নুন-স্বাদ অনুযায়ী
কীভাবে রাঁধবেন
কই মাছ কাটার পর ভালো করে ধুয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। মাছ কাটার সময় যদি মাছ বড় হয় তবে মাছগুলোর গা একটু করে চিরে দিতে হবে। চই- এর ওপরের ছাল ছাড়িয়ে ১ আঙুল লম্বা, মাঝারি চওড়া ও ১ ইঞ্চি পুরু মাপে কেটে নিতে হবে। কড়াইতে সর্ষের তেল দিয়ে গরম করে বড়িগুলো ভাজতে হবে। তেল কমে এলে আবার তেল দিয়ে নুন হলুদ মাখানো মাছ হালকা করে ভেজে নিতে হবে। মাছ ভাজার তেল ঢেলে রেখে নতুন করে তেল দিয়ে গরম করতে হবে। তেল গরম হলে জিরে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের গন্ধ বের হলে হলুদ গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো আর আদাবাটা অল্প জলে গুলে তেলে দিতে হবে। মশলা কষা হলে চই দিয়ে বেশ করে নাড়াচাড়া করে জল দিতে হবে। ঝোল ফুটে উঠলে হালকা ভাজা কই মাছ, বড়ি, কাঁচালঙ্কা আর নুন দিয়ে আবার ফোটাতে হবে। এই রান্নায় ঝোল ঘন হবে না। চই থাকায় রান্নার স্বাদ হবে সম্পূর্ণ নতুন রকমের। গরম ভাতে চই কই – এর স্বাদ নিলেন মন বলে উঠবে “এ স্বাদের ভাগ হবে না”।
চিতল মাছের সিংড়ি
কী কী লাগবে
চিতল মাছের পেটি-৫০০গ্রাম
হলুদগুঁড়ো-৬ চা চামচ
ধনে গুঁড়ো-৩ চা চামচ
জিরে গুঁড়ো-২ চা চামচ
কাঁচালঙ্কা বাটা-১ চা চামচ
কালোজিরে বাটা-৪ চা চামচ
কালোজিরে- ফোড়নের জন্য
কাঁচা লঙ্কা-৪ টে
তেজপাতা- ২ টো
সর্ষের তেল-রান্নার মতো
ঘি-বড় ১ চামচ
নুন-আন্দাজমতো
কীভাবে রাঁধবেন
বাজারে চিতল মাছের পেটি আলাদা করে কিনতে পাওয়া যায়। মাছের পেটি ভালো করে ধুয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে।কালোজিরে মিহি করে বেটে নিতে হবে। ২ টো কাঁচালঙ্কা বেটে রাখতে হবে। কড়াইতে সর্ষের তেল দিয়ে মাছ হালকা করে ভেজে নিতে হবে। কড়াইতে তেল থাকলে সেই তেল ঢেলে রেখে কড়াই পরিষ্কার করতে হবে। তারপর কড়াইতে আবার তেল দিয়ে গরম করে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা আর তেজপাতা ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের গন্ধ বের হলে হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো অল্প জল দিয়ে গুলে কড়াইতে দিতে হবে। মশলা ভালোভাবে কষিয়ে জল দিতে হবে। ঝোল ফুটে উঠলে ভেজে রাখা মাছ, গোটা কাঁচালঙ্কা আর নুন দিয়ে আবার ফোটাতে হবে। ঝোল একটু শুকিয়ে এলে কালোজিরে বাটা আর কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে আঁচ সামান্য কমিয়ে ঝোল মোটামুটি গাঢ় করতে হবে। গ্যাস বন্ধ করে ঝোলে ঘি ছড়িয়ে দিলেই তৈরি হাতে গরম চিতল মাছের সিংড়ি। এ পদের স্বাদে মজতে চাইলে খেতে হবে গরম ভাতের সঙ্গে।
সর্ষেবাটা দিয়ে আড় ফ্রাই
কী কী লাগবে
বড় আড়মাছের গাদার অংশ- ৫০০ গ্রাম
সর্ষে ( কালো অথবা সাদা)- বড় চামচের ৪ চামচ
আতপ চালের গুঁড়ো- ৩ বড় চামচ
ময়দা-৩ বড় চামচ
হলুদ গুঁড়ো-৩ চা চামচ
কাঁচালঙ্কা বাটা-১ চা চামচ
লেবু-১ বড় টুকরো
ভাজার জন্য-সর্ষের তেল
নুন- আন্দাজমতো
কীভাবে রাঁধবেন
আড় মাছের ওপরের চামড়া ছাড়িয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এবার ২ ইঞ্চি মতো লম্বা, ২ ইঞ্চি মতো চওড়া, আর ১ ইঞ্চির মতো মোটা এই মাপে মাছ কেটে রাখতে হবে। প্রত্যেকটা মাছের টুকরোকে আবার মধ্যে দিয়ে এমন ভাবে চিরে নিতে হবে যাতে মাছের পিসের একদিক কাটা থাকবে কিন্তু অন্য দিক থাকবে জোড়া। এভাবে মাছ কেটে সামান্য নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। সামান্য নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে সর্ষে মিহি করে বেটে নিতে হবে। ওই সর্ষেবাটা থেকে ১ চামচ মতো সরিয়ে রেখে বাকি অংশে লেবুর রস দিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করে রাখতে হবে। কড়াইতে তেল দিয়ে মাছের টুকরোগুলো খুব হালকা করে ভেজে নিতে হবে। তারপর মাছগুলোর যে দিকটা খোলা সেই দিক দিয়ে হাতে করে বা চামচে করে এমন ভাবে সর্ষের পেস্টটা মাছের ভেতরে ঢোকাতে হবে যাতে মাছ ভেঙে না যায়। চালের গুঁড়ো আর ময়দা ভালো করে মিশিয়ে তাতে নুন, সামান্য কাঁচালঙ্কা বাটা, অল্প সর্ষেবাটা আর জল দিয়ে গোলা তৈরি করতে হবে। এবার কড়াইতে বেশি করে সরষের তেল দিয়ে গরম করে হালকা ভাজা আড় মাছের মশলা ভরা টুকরোগুলো চালের গুঁড়ো আর ময়দার গোলায় ডুবিয়ে মচমচে করে ভাজলেই তৈরি হবে আড় ফ্রাই।
চিঁড়ে দিয়ে মুড়িঘন্ট
কী কী লাগবে
রুই বা কাতলা মাছের মাথা- ১ কেজি ওজনের মাছের মাথা
চিঁড়ে-একটু মোটা চিঁড়ে-৫০০গ্রাম
আলু- ২৫০ গ্রাম
পেঁয়াজ-২৫০গ্রাম
আদা-৫০গ্রাম
হলুদ গুঁড়ো- বড় ২ চামচ
লঙ্কা গুঁড়ো-স্বাদ অনুযায়ী
শুকনো লঙ্কা-৪-৫টা
কাঁচা লঙ্কা-২-৩টে
তেজপাতা-৩-৪টে
গোটা গরমমশলা-ছোট এলাচ-২টো, দারচিনি- ২টো, লবঙ্গ- ২টো
গরমমশলাগুঁড়ো- আন্দাজমতো
চিনি- আন্দাজমতো
টক দই- ৫০ গ্রাম
সর্ষের তেল-প্রয়োজনমতো
ঘি- বড় ১ চামচ
নুন- আন্দাজমতো
কীভাবে রাঁধবেন
মাছের মাথা ভালো করে ধুয়ে চার টুকরো করে নুন হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিতে হবে। বড় আলু হলে চার টুকরো করে কেটে আর মাঝারি মাপের আলু হলে দু টুকরো করে ভেজে রাখতে হবে। আদা ও পেঁয়াজ একসঙ্গে বেটে নিতে হবে। মাছের মাথা ভাজার তেল ঢেলে কড়াই পরিষ্কার করে আবার তেল দিয়ে ও তেলের সঙ্গে কিছুটা ঘি মিশিয়ে গরম করে শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে আদা-পেঁয়াজবাটা দিয়ে ভালো করে কষতে হবে। কষার সময় ভেজে রাখা আলু দিয়ে দিতে হবে। হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, চিনি ও নুন দিয়ে কষতে হবে। মশলা থেকে তেল ছাড়লে দেখতে হবে আলু সেদ্ধ হয়েছে কি না। আলু শক্ত থাকলে অল্প জল দিয়ে, গ্যাস কমিয়ে কড়াই ঢাকা দিয়ে মিনিট সাতেক রাখলে আলু নরম হয়ে আসবে। তখন মাছের ভাজা মাথা দিয়ে আবারও কষিয়ে কিছুটা জল দিতে হবে। কাঁচা লঙ্কা দিতে হবে। জল প্রায় শুকিয়ে এলে চিঁড়ে ভালো করে ধুয়ে কড়াইতে দিতে হবে। মাছের মাথা, আলু আর চিঁড়ে বেশ মাখা মাখা হয়ে এলে গরমমশলাগুঁড়ো আর ঘি দিলেই তৈরি হয়ে যাবে চিঁড়ে দিয়ে মুড়িঘন্ট।