কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একটা ছোট্ট গ্রাম বেড়াচাঁপা। সেখানেই ঘুমিয়ে ছিল ২৫০০ বছরের ইতিহাস। প্রাচীন ভারতের মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল চন্দ্রকেতুগড়। কিন্তু এখন দেখে বোঝার উপায় নেই একসময় এই বন্দরই সরগরম থাকত ব্যবসায়ী, বনিকদের হাঁকডাকে।
পদ্মানদী এবং বিদ্যাধরী নদীর পাড় ঘেঁষে এই প্রত্ন স্থলে। গড়ে উঠেছিল ৪০০ থেকে ৮০০ শতাব্দীর মধ্যে। ১৯০৭ সালের ঘটনা। স্থানীয় চিকিৎসক তারকনাথ ঘোষ একদিন বন্ধ্যা ভূমিতে মাটির বাসনের কিছু ভাঙা টুকরো খুঁজে পান। টুকরোগুলো দেখে তাঁর মনে হয় বহু প্রাচীন। এই ধারনা থেকেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে চিঠি লেখেন।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পূর্ব ভারতের প্রধান এল এইচ লংগ্রাস্ট নিচে আসেন পরিদর্শনে। প্রথম আবিষ্কার করেন ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯০৯ সালে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৬ সাল থেকে টানা দশ বছর খনন কাজ চালায়। চন্দ্রকেতুগড়ের মাটির তলা থেকে
হাড়, রৌপ্য মুদ্রা, স্বর্ণমুদ্রা, পোড়া মাটির সামগ্রী, হাড় ও হাতির দাঁতের বস্তু,
রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় জিনি মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেছিলেন তিনি চন্দ্রকেতুগড় পরিদর্শন করেন। সেই সময় টেরাকোটার স্তুপ খুঁজে পান।
১৯২০ সালে ‘বসুমতী’ সংবাদপত্রে চন্দ্রকেতুগড় নিয়ে নিজের ভাবনার কথা লিখেছিলেন তিনি। ১৯২২-২৩ সালের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বার্ষিক প্রতিবেদনে কাশীনাথ দীক্ষিত লেখেন, "চন্দ্রকেতুগড় বাংলার প্রাচীনতম জনবসতিগুলির অন্যতম।"
সেই দেখেই আশুতোষ মিউজিয়াম অফ আর্টের সদস্যরা কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের উদ্যোগে চন্দ্রকেতু গড়ের অতীত খননের দায়িত্ব নেন। অনেকেই চন্দ্রকেতুগড়কে গাঙ্গরিদাই- এর অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছেন।
গ্রিক ভৌগলিক টলেমি তাঁর লেখা জিওগ্রাফিয়াতে ভারতের চারটি জায়গার কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে একটি বন্দর নগরী চন্দ্রকেতুগড়। যা প্রমাণ করে সরাসরি না হলেও গ্রীস, রোমের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। জলপথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত রোমের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে।
ধাতু সংক্রান্ত বাণিজ্য চলত। ধ্বংস স্তূপ থেকে পাওয়া মুদ্রাও তার সাক্ষ্য বহন করে। যক্ষী মূর্তি এবং পশুপাখির মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। খাজুরাহের যক্ষী মূর্তির সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য।
চারটি স্তরে চলেছিল খননের কাজ। ২০০০ বছরের পুরনো একটি গড় উদ্ধার হয়। ৩০ ফুটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। মৌর্য এবং গুপ্ত যুগের মধ্যবর্তী সময়ে যা নির্মিত হয়েছিল।
এই জায়গার নাম চন্দ্রকেতুগড় কেন হল তার কোনও সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে মনে করা হয় চন্দ্রকেতু নামে একআরজা ছিলেন। তার নাম থেকেই নাম হয় চন্দ্রকেতুগড়।
কেউ কেউ বলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাম অনুসারে চন্দ্রকেতুগড় নাম হয়েছে।
২০০১ সালে চন্দ্রকেতুগড়ে কাজ বন্ধ করে দেয় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।
যদিও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত পঞ্চচূড় অপ্সরা, নগরশ্রেষ্ঠীর ও গজদন্ত শিল্প ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামি সংগ্রহালয়ে রয়েছে। ভারতীয় জাদুঘর এবং আশুতোষ মিউজিয়ামেও রাখা আছে এখানকার সংগ্রহ। চন্দ্রকেতুগড়ে ২০১৭-তে একটি মিউজিইয়াম গড়ে তোলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।