১৮৬৭ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার যশাইকাটিতে মায়ের পৈতৃক ভিটেতে ২৩ জুন জন্ম হয় তাঁর। বাবা নিবারণচন্দ্র। মা জগৎমোহিনী দেবী। প্রাথমিক পড়াশোনা মামার বাড়িতেই। স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই। বেতন দেওয়ার টাকা নেই। কোনক্রমে স্কুল শেষ করে বিএ তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই আর্থিক অনটনে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। আগাগোড়া অভাবসংকটের ভিতর বেড়ে ওঠা যাকে বলে। অথচ সেই তিনিই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার মতো মহৎ কিছুর পৃষ্ঠপোষক, শব্দ অনুসন্ধানী, ভাষার চিকিৎসক, পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব- হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁকে এ যাবৎ খুব কাছাকাছি রাখা হয়, এমনটা হয়ত কখনই আর বলা যাবে না; তাঁর বহু যত্নে গড়া ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এর প্রয়োজন এখন ‘লিমিটেড’। তিনিও স্মরণাতীত। তবে তাঁর ‘লিমিটেড’ অনুগামীদের মধ্যে যাঁরা পড়েন তাঁরা হয়তো এখনও মনে রাখেন তাঁকে, তাঁর জন্মদিন।
কর্মসূত্রে জীবনের অনেককালই কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে প্রায় বছর তিনেক শিক্ষকতা করা হয়ে গিয়েছে, ঠিক সেসময়েই এক দিন হরিচরণের কাছে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্ব-ইচ্ছা জানালেন।
জানালেন- “আমাদের বাংলা ভাষায় কোনও অভিধান নেই, তোমাকে একখানি অভিধান লিখতে হবে।“
রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধে তিনি অতি উদ্যোমে শুরু করে দেন শব্দ-অর্থ সন্ধানের কাজ। রবীন্দ্রনাথও তাঁর নিষ্ঠা দেখে খুশি হয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিপাঠীকে লেখেন, “এ গ্রন্থখানি রচিত ও প্রকাশিত হইলে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইবে।“
তবে অর্থকষ্ট তাঁর পিছু না ছাড়ায় তাঁকে অভিধানের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে আশ্রম ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। সেসময় খুব আর্থিক টানাপোড়েন চলছিল শান্তিনিকেতনে। বাধ্য হয়েই ছেড়েছিলেন আশ্রম। তারপর ক্ষুদিরাম বসুর সাহায্যে একটা চাকরি জোটালেন। সেন্ট্রাল কলেজে সংস্কৃত পড়ানোর চাকরি। পড়ানোর চাকরি করছেন অথচ মনপ্রান সবই তাঁর গুরুদেবের সেই ইচ্ছাপূরণেই পরেই। মানসিক কশাঘাতে একদিন গিয়ে পৌঁছলেন জোড়াসাঁকোয়, সবটা বললেন রবীন্দ্রনাথকে।
সবটা মন দিয়ে শুনে তাঁর হিল্লে করে দেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাছে। হরিচরণ মাসিক পঞ্চাশ টাকা বৃত্তি পেতে শুরু করেন মহারাজার তরফে। বেহাল অবস্থায় খানিক স্থিতি আসে। বৃত্তি পেয়ে তিনি সেই যে কলকাতা ছেড়েছিলেন ১৯৫৯ সাল অবধি আমৃত্যু শান্তিনিকেতনেই থেকে গিয়েছিলেন হরিচরণ। যেটুকু অর্থ সঞ্চয়ে রাখতে পেরেছিলেন তার সবটাই দিয়ে দিয়েছিলেন অভিধান প্রকাশের কাজে। ‘বিশ্বকোষ’-এর নগেন্দ্রনাথ বসু নিয়েছিলেন বই প্রকাশের দায়িত্ব। একে একে তেরো বছর ধরে মোট একশো পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশ পায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। তা উৎসর্গিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রতি।
বিশ্বভারতী অভিধান বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়। অর্থ সাহায্য আসে রথীন ঠাকুর, নাড়াজোলার মহারাজা, আশ্রমিক সঙ্ঘ, বিশ্বভারতী সংসদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। প্রশ্নংসা আসে মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে। গান্ধী তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় হরিচরণকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিলবার্ট মারের সঙ্গে তুলনা করেন। হরিচরণের মৃত্যুর পর দু’টি খণ্ডে গোটা অভিধানটি প্রকাশ করে সাহিত্য অ্যাকাডেমি।
শুধুমাত্র বঙ্গীয় শব্দকোষই নয়, হরিচরণ রবীন্দ্রনাথকে গুরুদক্ষিণায় দিয়েছিলেন নিজের দু’টি চোখও। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে তাঁকে বলতে শোনা যেত, ‘‘গুরুদেবের নির্দিষ্ট কাজে চোখ দু’টো উৎসর্গ করতে পেরেছি, এটাই পরম সান্ত্বনা।’’
অভিধান নিয়ে তাঁর প্রজ্ঞা সম্বন্ধে সুরঞ্জন ঘোষের একটি লেখায় বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে— ‘‘প্রতিদিন সান্ধ্য আহ্নিক সেরে লন্ঠনের আলোয় কুয়োর ধারে খড়ের চালাঘরে পশ্চিম জানলার কাছে হরিবাবু কাজ করতেন। সুনীতিকুমারের স্মৃতিতেও এই ‘ক্ষীণপ্রায় ব্রাহ্মণ’-এর ছবিটা প্রায় একই রকম। সুনীতিবাবু যখনই হরিচরণের বাড়ি যেতেন, তখনই দেখতেন তক্তপোষের উপর ডাঁই করে রাখা উর্দু, পার্সি, ইংরেজি, ওড়িয়া, মারাঠি-সহ বিভিন্ন ভাষার অভিধান ছড়ানো রয়েছে। দ্বিজেন ঠাকুর তো ছড়াই বেধে ফেলেছিলেন, ‘‘কোথা গো মেরে রয়েছ তলে/ হরিচরণ, কোন গরতে?/ বুঝেছি, শব্দ-অবধি-জলে/ মুঠাচ্ছ খুব অরথে।।’’
হরিচরণ-এর শব্দ-শব্দার্থ আগ্রহের বিষয়টি প্রথম ধরা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের কাছেই। শিক্ষিত-সংস্কৃতজ্ঞ হরিচরণ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের পতিসরের জমিদারির সেরেস্তা। একদিন জমিদারির কাজকর্ম দেখতে এসে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন হরিচরণ দিনে সেরেস্তার কাজ করলেও সন্ধ্যের পর থেকে তাঁর কাজের পরিসর যেত পাল্টে। সন্ধ্যার পর চলত সংস্কৃত আলোচনা। বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে প্রেসের কপি-পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা। সেইসব পাণ্ডুলিখি নিরীক্ষণ করেই হরিচরণের গূঢ় রহস্য ভেদ করে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় এবং অবশ্যই ঠাকুর পরিবারের দিকপালদের সঙ্গে একই সারিতে রবীন্দ্রনাথ হরিচরণকে ঠাঁই দিয়েছিলেন অধ্যাপক হিসেবে। তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ও মূল্যবান । ‘কবির কথা’; অনূদিত গ্রন্থ ম্যাথু আর্নল্ডের ‘সোরাব রোস্তম’, এবং ‘বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র’, ‘কবিকথা মঞ্জুষা’; ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ ‘সংস্কৃত প্রবেশ’, ‘পালি প্রবেশ’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘হিন্টস অন সংস্কৃট ট্রান্সশ্লেষন অ্যান্ড কম্পোজিশন’ ইত্যাদি। অনূদিত গ্রন্থগুলো অমিত্রা র ছন্দে রচিত। স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন ‘দেশিকোত্তম’, বিশ্বভারতীর ডি–লিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি।
সময়ের মলিনতা মেখে প্রজন্মের কোনও এক শিক্ষার তাকে এখনও কি রয়ে গিয়েছেন সেই ‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’?