প্রবাদ আছে "চালকুমড়ি করা"। অর্থাৎ চালের ওপর দিয়ে কুমড়োর মতো গড়িয়ে ফেলে দেওয়া। লোকজীবন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতা থেকেই তো প্রবাদের জন্ম। আগেকার দিনে চালকুমড়ো মূলত মাটির বাড়ির চালেই ফলত। সেদিন আর নেই। এখন তাই মাচাতেই চালকুমড়ো বেশি ফলে। তবে প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত, তেতো থেকে ঝাল- সব স্বাদেই বাঙালির রন্ধন ঘরানায় এই আনাজটি যে নিজস্বতায় উজ্জ্বল তার প্রমাণ রইল আজকের লেখায়।
তিতকুমড়ি
তিতকুমড়ি বললেই বেশ তেতো, তেতো স্বাদ যেন জিভে জড়িয়ে যায়। অথচ এ রান্নায় আদৌ কোনও তেতো ব্যাপার নেই। ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’র মতোই তেতো নয় চালকুমড়োর এমন পদটি হল তিতকুমড়ি।
কী কী লাগবে
চালকুমড়ো- কচি মাঝারি সাইজের ১টা
নারকেল- ১টি বড় নারকেলের অর্ধেক মালা
সরষে
নুন
মিষ্টি
শুকনো লঙ্কা
কাঁচা লঙ্কা
সরষের তেল
কী ভাবে রাঁধতে হবে
চালকুমড়ো ভালভাবে ধুয়ে নিয়ে খুব সরু সরু করে কাটতে হবে। নারকেল কুরিয়ে রাখতে হবে। সর্ষে ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে সামান্য নুন ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে মিহি করে বেটে নিতে হবে। কালো সর্ষের ঝাঁঝ বেশি হলেও ইদানীং অনেকেই শারীরিক নানা সমস্যা হয় বলে সাদা সর্ষেই পছন্দ করেন। এই রান্নায় যেকোনও সর্ষেবাটাই ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্যাসে কড়াই বসিয়ে তেল দেবার সময় মনে রাখতে হবে-চালকুমড়ো রাঁধতে হলে খুব বেশি তেল লাগে না। তাই তেল দিতে হবে চালকুমড়োর পরিমাণ বুঝে। সর্ষের তেল ভাল গরম হলে শুকনো লঙ্কা ও সর্ষে ফোড়ন দিয়ে কেটে রাখা চালকুমড়ো দিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে। নুন ও চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে কড়াইয়ের ওপর ঢাকা দিয়ে আঁচ কমিয়ে রাখতে হবে। চালকুমড়ো থেকে যে জল বেরোবে সেই জলেই চালকুমড়ো সিদ্ধ হবে। মিনিট পাঁচেক পরে ঢাকা তুলে দেখতে হবে চালকুমড়ো সিদ্ধ হয়েছে কি না। কেননা জল শুকিয়ে গেলে কড়াইয়ের তলায় লেগে যেতেও পারে। তাই খুন্তি দিয়ে খুব ভালোভাবে নাড়তে হবে। একদম তলা পর্যন্ত খুন্তি নিয়ে যেতে হবে। চালকুমড়ো প্রায় সিদ্ধ হয়ে এলে সর্ষেবাটা, নারকেল কোরা, চিনি ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে। প্রয়োজন মনে করলে আবার আঁচ কমিয়ে থালা চাপা দিয়ে অল্পক্ষণ রাখা যায়। এরপর আঁচ বাড়িয়ে খুন্তি দিয়ে নাড়তে নাড়তে চালকুমড়ো প্রায় মন্ড মতো হয়ে গেলে নামিয়ে রাখতে হবে। অনেকে নামানোর সময় সরষের তেল ছড়িয়ে নামিয়ে থাকেন। এটা ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর নির্ভর করে।
চালকুমড়োর পাটভাজা
শত হলেও বর্ষাকাল। বর্ষা এবার নিতান্ত কৃপণা হলেও মাঝে মাঝে যেটুকু দর্শন দিচ্ছে তাতেই গরম ভাতে চমৎকার লাগবে চালকুমড়োর পাটভাজা।
কী কী লাগবে
চালকুমড়ো – ১ টি। কচি হলেই ভালো।
বেসন- গোলা করার জন্য। চালকুমড়োর পরিমাণ বুঝে নিতে হবে।
চালের গুঁড়ো- গোলা করার জন্য। বেসনের অর্ধেকের চেয়ে একটু কম পরিমাণে নিতে হবে।
সর্ষে- সাদা অথবা কালো যেকোনও সর্ষেই নেওয়া চলে।
কাঁচা লঙ্কা-
নারকেল- ১টি
নুন- স্বাদ অনুযায়ী
কালোজিরে- সামান্য
চিনি-যদি প্রয়োজন মনে হয়
ভাজবার জন্য- সরষের তেল
কীভাবে রাঁধবেন?
চালকুমড়ো ভাল করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। যদি চালকুমড়ো বড় হয় তাহলে প্রথমে পেটের মধ্যে দিয়ে অর্ধেক করে নিতে হবে। তারপর একটু মোটা মোটা করে গোল গোল টুকরো করতে হবে।যদি চালকুমড়ো বেশ মোটা হয় তবে প্রথমে লম্বালম্বিভাবে কেটে নিয়ে তারপর আধো চাঁদের আকারে মোটা মোটা পিস করতে হবে। এই গোল অথবা আধো চাঁদ অংশটির আবার একদিকটা ছুরি দিয়ে এমন ভাবে চিরতে হবে যাতে পেছনের অংশ তো জোড়া থাকবেই এমনকি দুপাশের অংশও জোড়া থাকবে। কেবল মধ্যেখানে ফাঁক হবে। এবার নারকেল কুড়িয়ে নিয়ে মিহি করে বাটতে হবে। সর্ষে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বেটে নিতে হবে। এবার সর্ষেবাটা আর নারকেলবাটা ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। মিষ্টি স্বাদ পছন্দ করলে একটু চিনি দেওয়া যেতে পারে। চালকুমড়োর কাটা অংশ ফাঁক করে তাতে অল্প করে নারকেলবাটা আর সর্ষে বাটার মিশ্রণ দিয়ে চেপে রাখতে হবে। বেসন আর চালের গুঁড়ো মিশিয়ে তাতে নুন আর কালোজিরে দিয়ে গোলা তৈরি করতে হবে। গোলা ঘন হতে হবে। পাতলা গোলা হলে তেলে দিলেই ভাজা খুলে যাবে। কড়ায় তেল গরম করে নারকেল- সর্ষের পুর ভরা চালকুমড়ো গোলায় ডুবিয়ে আঁচ কমিয়ে মচমচে করে ভেজে নিলেই তৈরি চালকুমড়োর পাটভাজা।
চালকুমড়োর চাপরঘন্ট
চাপরঘন্ট সেকালের পূর্ববঙ্গের এক বিখ্যাত রান্না। ডাল বেটে নিয়ে হাতের চাপে বড় বড়ার আকারে ভেজে এই রান্না করা হয় বলে এর নাম চাপরঘন্ট।
কী কী লাগবে
চালকুমড়ো- ১টা (কচি দেখে নিতে হবে)
মটরডাল- ২৫০ গ্রাম
আদাবাটা
সর্ষে
পাঁচফোড়ন
তেজপাতা
শুকনো লঙ্কা
কাঁচালঙ্কা
সর্ষের তেল
ঘি
কীভাবে রাঁধবেন?
চাপরঘন্ট রাঁধতে হলে আগের দিন রাতে মটরডাল ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে সেই ভেজানো মটরডাল বাটতে হবে। শিলপাটায় অথবা মিক্সিতে বেটে নিতে হবে। খুব মিহি করে বাটবার দরকার নেই। চালকুমড়ো ভালোভাবে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে সরু সরু করে কাটতে হবে। গ্যাসে কড়া চাপিয়ে তাতে বেশি করে সরষের তেল দিতে হবে। তেল গরম হবার সময় ডালবাটাটা হাত দিয়ে খুব ভালো করে ফেটাতে হবে। তেল তেতে উঠলে হাতের তালুর চেয়েও বড় আকারের বড়ার মতো ‘চাপর’ বানিয়ে তেলে ছাড়তে হবে। এই চাপর কিন্তু খুব কড়া করে ভাজতে হবে। ২/৩টে চাপর তো হবেই। প্রথম চাপর ভাজার পর তেল কমে গেলে আবার তেল দিয়ে গরম করে চাপর বানাতে হবে। চাপর ভাজার সময় খুন্তি দিয়ে মধ্যেখানে একটু গর্ত করে দিলে ভেতরটা কাঁচা থাকবে না।দরকার হলে আরও ভেঙে দিতে হবে। চাপর কড়া ভাজা হলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। ঠান্ডা হলে হাত দিয়ে আধভাঙা করতে হবে। সর্ষেও আধভাঙা করে রাখতে হবে। কড়ায় তেল কমে গেলে আবার তেল দিয়ে গ্যাসে বসাতে হবে। তেল তেতে উঠলে শুকনো লঙ্কা, পাঁচফোড়ন আর আধভাঙা সর্ষে ফোড়ন দিয়ে চালকুমড়ো দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দুটো কাঁচালঙ্কা চিরে, নুন দিয়ে নাড়াচাড়া করে গ্যাস একটু কমিয়ে কড়াতে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। মিনিট ৫/৭ পরে ঢাকা তুলে দেখতে হবে নিচে লেগে গেছে কী না। খুন্তি কড়াইতে ভালোভাবে নীচ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বুঝতে হবে। চালকুমড়ো যদি সিদ্ধ কম হয় তবে আবার আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। চালকুমড়ো কচি হলে প্রচুর জল বেরোবে। সেই জলেই চালকুমড়ো সিদ্ধ হয়ে যাবে। চালকুমড়ো প্রায় মজে এলে আদাবাটা, কাঁচালঙ্কা ও চিনি দিয়ে নেড়ে নিয়ে ডালের চাপরগুলো ভেঙে কড়াইতে দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে। চালকুমড়ো আর ডালের চাপর মিশে যাবে কিন্তু ঝরঝরে থাকবে। নামাবার সময় ঘি দিয়ে নামিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করতে হবে।